একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছেন বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান। শাস্তি যখন পেয়েছে যেখানেই লুকিয়ে থাকুক আল্লাহর ওপর আমার আস্থা আছে, একদিন না একদিন তাকে সাজা পেতেই হবে এবং সাজাও ভোগ করতে হবে। তিনি বলেন, তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আমরা আলাপ-আলোচনা করছি। আগামী নির্বাচনে আবার আমরা যদি জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ফিরে আসতে পারি, অবশ্যই আমরা তাকে ফিরিয়ে আনতে পারব ইনশাল্লাহ।
গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্বে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য ফজিলাতুন নেসা বাপ্পির সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। এসময় অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, হত্যা ও মানুষের ওপর অত্যাচার করা এটা তাদের (বিএনপি) স্বভাব। জিয়াউর রহমান যেমন ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁর স্ত্রী (খালেদা জিয়া) ও পুত্র (তারেক রহমান) ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল-এতে কোনো সন্দেহ নেই। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যারা (তারেক রহমান) এত বড় জঘন্য ঘটনা ঘটিয়েছে, প্রকাশ্য দিবালোকে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত গ্রেনেড রাজপথে ব্যবহার করে যারা ২২ জন মানুষকে হত্যা করেছে, তাদের সাজা ভোগ করতে হবে। এজন্য আমি দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই, ভোটও চাই-যেন আমরা পুনরায় দেশ সেবার কাজে ফিরে এসে এই অন্যায়-অবিচারের বিচার করতে পারি। সাজাটা আমরা যেন কার্যকর করতে পারি তার জন্যও দেশবাসীর দোয়া চাই।
জাতীয় পার্টির (এ) বেগম রওশন আরা মান্নানের পৃথক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের মানুষের সেবা করার সুযোগ পেতে নৌকা মার্কায় ভোট চাই। ফের ক্ষমতায় আসতে পারলে ২১ আগস্টের মতো সকল অন্যায়-অবিচার, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস-মাদকমুক্ত করে দেশের মানুষের শান্তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করব। আগামী নির্বাচনে দেশের জনগণকে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতে আমরা পিছপা হই না, রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করি। তবে কেউ যদি জঙ্গি-সন্ত্রাস বা মাদকের সঙ্গে জড়িত থাকে সেই বিচার করাটাও রাষ্ট্রের কর্তব্য।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুসহ আমার পরিবারের ১৮ জনকে হত্যা করা হয়। তখন খুনিদের বিচার না করে ইনডেমনিটি দিয়ে রক্ষা করা হয়। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। আমরা দু’বোন বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যাই। ১৯৮১ সালে যখন দেশে ফিরে আসি তখন বঙ্গবন্ধুর খুনি, স্বাধীনতাবিরোধীরা ক্ষমতায়। তখন অনেক ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে আমাদের রাজনীতি করতে হয়েছে। এরপর বারবার আমার ওপর গুলি, বোমা, গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। সবশেষ আমাকে রাজনৈতিক ও শারীরিকভাবে শেষ করে দিতেই এই হামলা চালানো হয়। নেতাকর্মীরা মানবপ্রাচীর তৈরি করে আমাকে রক্ষা করে। কিন্তু সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢাকা যায় না। মামলার রায়ে সত্য ঘটনা বেরিয়ে এসেছে। এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে পেরেছি এটাই বড় কথা।
ক্ষমতায় আসতে জনগণের ভোট-সমর্থন যেমন প্রয়োজন, তেমনই আল্লাহ’র ইচ্ছাটাও বড় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার জীবনের একটাই লক্ষ্য, দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করা। জীবনে নিজে কি পেলাম বা পেলাম না সেটা বড় কথা নয়, দেশের মানুষকে কি দিতে পারলাম, তাদের ভাগ্যের কতটুকু পরিবর্তন করলাম সেটাই আমার একমাত্র লক্ষ্য। তিনি বলেন, গত ১০ বছর একটানা ক্ষমতায় রয়েছি বলেই দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলো এখন দৃশ্যমান হচ্ছে, যার সুফল দেশের জনগণ পাচ্ছে। সরকারের ধারাবাহিকতা রয়েছে বলেই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু , কর্ণফুলী টানেল, মেট্রো রেলসহ বড় বড় মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ চলছে। ২০২১ সাল পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারব কি না জানি না, কেননা বয়স হয়েছে। তবে আমি চাই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা যেন অব্যাহত থাকে। আমরা দেশকে অবশ্যই দারিদ্রমুক্ত করব। জঙ্গির বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলবে। জঙ্গি-সন্ত্রাস-মাদক ও দুর্নীতিমুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্রমুক্ত উন্নত দেশ হিসেবে আমরা গড়ে তুলবই।
গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট প্রসঙ্গে সরকারি দলের সংসদ সদস্য সাগুফতা ইয়াসমীন এমিলির প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, রাজনৈতিকভাবে যারা জোট করেছে তাদেরকে আমি স্বাগতই জানাই। আমি মনে করি সকলেরই রাজনীতি করার অধিকার আছে। তবে এখানে (জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট) যারা যুক্ত হয়েছেন তাদের যে কথাবার্তা, যা কিছু এখন মানুষ জানতে পারছে বা শুনতে পারছে, তাদের কেউ কেউ মানুষকে সম্মান রেখেই কথা বলতে পারছে না। আমি আশা করি, তারা সংযত হবে। কেননা জনগণের জন্য কাজ করতে হলে যে সহনশীল হতে হয়, যে ত্যাগ দরকার সেই ত্যাগ বা সহনশীলতা তাদের মধ্যে নেই। আমি আশা করি তারা যদি সত্যিই রাজনীতির জন্য জোট করে এগিয়ে যেতে চান-তবে অবশ্যই তাদের সেভাবে চলতে হবে। তবে আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, যে কোনোভাবেই হোক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মোকাবিলা করতে আমি পিছপা হই না।
নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা ও প্রাণে বাঁচতে মিয়ানমার থেকে এদেশে আসা রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে মানবতাবাদী, সাহসী, দূরদর্শী ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের জন্য এবছর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে আমাকে দুটি সম্মাননা প্রদান করা হয়। প্রদত্ত এই সম্মাননা দু’টি বাংলাদেশের জনগণের জন্য অত্যন্ত গৌরবের। আমি দুটি সম্মাননাই দেশের জনগণকে উৎসর্গ করি। আমার দেশের মানুষ রোহিঙ্গাদের জন্য তাদের দুয়ার খুলে দিয়ে, আহার ভাগাভাগি করে আমার সিদ্ধান্তকে সমর্থন দিয়েছেন এবং আমাকে সার্বক্ষণিক সাহস যুগিয়েছেন। আমি বিশেষ করে কক্সবাজারের মানুষকে তাদের অব্যাহত ত্যাগের জন্য ধন্যবাদ জানাই।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে সংসদ নেতা জানান, মিয়ানমার থেকে আসা বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের ছবিযুক্ত আইডি কার্ড করে দেওয়া হয়েছে। তারা যেন নির্ধারিত ক্যাম্পের মধ্যেই থাকে সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারা ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে যাতে কোনো ধরনের সন্ত্রাসীমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে না পারে সেজন্য সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
মুজিবনগর স্মৃতি কেন্দ্রের উন্নয়নে ৫শ’ কোটি টাকার প্রকল্প : সরকারি দলের সদস্য ফরহাদ হোসেনের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুজিবনগর স্মৃতি কেন্দ্রের উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের জন্য প্রায় ৫শ’ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কেন্দ্রটি আরও আকর্ষণীয় হবে এবং মুজিবনগর স্মৃতিসৌধসহ মুজিবনগর কমপ্লেক্স সংলগ্ন জায়গাটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পর্যটন এলাকা হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে।