মানসজগত গঠনের ক্ষেত্রে স্মৃতি বড় ভুমিকা পালন করে। সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, মানবকুল প্রায় ১১ হাজার বছর পুর্বে গ্রামীণ(কৃষিজ) জীবন শুরু করে। শিল্প বিপ্লবের পর দেশের একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী নগরে বসবাস আরম্ভ করে। বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী নগরে বসবাস করছে। এদেশেও নগরে বসবাসকারী লোকের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মানসজগতে রয়ে গেছে গ্রামীণ সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব।আমাদের গল্প-উপন্যাস- সিনেমা সবই গ্রামীণ জীবনকে কেন্দ্র করে রচিত। ফলে আমরা নগরীয় সভ্যতাকে অকুণ্ঠ চিত্তে স্বাগত জানাতে পারছি না। তাছাড়া আমাদের বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশ মনে করেন-‘গ্রামকে শোষণ করে শহর গড়ে উঠেছে। শহরে শোষকরা বসবাস করে।’
তাদের এই ধারণার পিছনে যুক্তি আছে; তাঁরা দেখে আসছেন নগরকে ঘিরেই যাবতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। শহরেই সকল নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। কিন্তু বিলম্বে হলেও সরকার গ্রামে নগরীয় সুযোগ-সুবিধা দেয়ার জন্য বহু প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। আমরা ভুলে যাই যে, গ্রামের উন্নয়ন হওয়া মানেই ‘নগর’ হয়ে যাওয়া। তাছাড়া বর্তমান সরকার ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ নামক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তবে বর্তমান বাংলাদেশ পুরোপুরি গ্রামও নয়, পুরোপুরি নগরও নয়। সেকারণে আমাদের মাঝে গ্রামীণ-নগরীয় সংস্কৃতির প্রভাব লক্ষ্যনীয়। একই কারণে সমগ্র দেশে এক ধরণের ক্ষতিকর অস্থিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাংলাদেশে নগরায়নের ধারণা প্রথমে নিয়ে আসেন নিউইয়র্ক প্রবাসী গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের প্রবক্তা আবু তালেব।
তিনি ১৯৯৭ সালে ১৩ জানুয়ারি ঢাকা যাদুঘরে অনুষ্ঠিত ” স্থানীয় সরকারঃ গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত’ শীর্ষক এক সেমিনারে বলেন -বর্তমান বাংলাদেশকে গ্রামীণ বাংলাদেশ বলা ঠিক হবে না, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে গ্রামীণ- নগরীয় দেশে অনুপ্রবেশ করেছে। ২০২০ সালে বাংলাদেশে প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী এবং ২০৫০ সালে পুরো জনগোষ্ঠী নগরে বসবাস করবে। উল্লিখিত সেমিনারে তিনি স্থানীয় সরকারের স্তরবিন্যাস করে দেখান যে, তিন ধরণের স্থানীয় সরকার বিদ্যমান রয়েছে ; যথা-গ্রামীণ সরকার, গ্রামীণ-নগরীয় স্থানীয় সরকার আর নগরীয় স্থানীয় সরকার। ইউনিয়ন পরিষদ সমুহ, আর যেসব উপজেলার আয়তনে পৌরসভা নেই সেগুলো গ্রামীণ ইউনিট, যেসব উপজেলার আয়তনে পৌরসভা আছে সেগুলো ও জেলাগুলো গ্রামীণ-নগরীয় ইউনিট এবং পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডগুলো নগরীয় ইউনিট। তবে সরকারের বিভিন্ন দফতর ও পাঠ্যপুস্তকে দুই প্রকারের স্থানীয় ইউনিটের কথা উল্লেখ আছে তথা, গ্রামীণ ইউনিট ও নগরীয় ইউনিট। গ্রামীণ-নগরীয় বাংলাদেশ ভবিষ্যতে কীভাবে নগরীয় বাংলাদেশে রূপান্তরিত হবে সে বিষয়ে একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।
যেমন-বর্তমানে ৩৮% জনগোষ্ঠী নগরে বসবাস করে। এ ধারা বজায় থাকলে ২০৩০ সালে ৫৫% এবং ২০৫০ সালে ৭৫% জনগোষ্ঠী নগরে বসবাস করবে। সে কারণে কৃষি পেশায় নিয়োজিত লোকের সংখ্যা কমতে থাকবে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ৮৫% লোক কৃষি পেশায় জড়িত ছিল, বর্তমানে ৪০% লোক কৃষি পেশায় জড়িত আছে। নিত্য-নতুন প্রযুক্তি আবিস্কারের কারণে কৃষি পেশার শ্রমশক্তি দ্রুত হ্রাস পেতে থাকবে এবং অনেকে মনে করেন ২০৫০ সাল নাগাদ মাত্র ২০% থেকে ২২% শ্রমশক্তি কৃষি পেশায় নিয়োজিত থাকবে। অর্থাৎ কৃষিতে শুধু দক্ষ শ্রমিকরাই টিকে থাকবে। সেজন্য অদক্ষ কৃষি শ্রমিকদের অকৃষি পেশায় কর্মসংস্থানের জন্য এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। বর্তমানে সমগ্র দেশে প্রায় ২০ হাট-বাজার রয়েছে। হাট-বাজার কেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যে যারা জড়িত আছেন, তারা সকলেই অকৃষি পেশার লোক। ভবিষ্যতে এসব হাট-বাজারকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন নগর সৃষ্টি হবে। এসব হাট-বাজারে ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারে শিল্পকারখানা স্থাপন সহ বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য আরম্ভ করা সম্ভব হলে অদক্ষ কৃষি শ্রমিকরা বাড়ির কাছেই কর্মসংস্থান পেয়ে যাবে। আশার কথা, বর্তমান সরকার সম্প্রতি হাট-বাজার কেন্দ্রিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।
সেজন্য সকল রাজনৈতিক দলকে নগর সভ্যতাকে স্থায়ী সভ্যতা হিসেবে মেনে নিতে হবে। তাহলে এর প্রতি দরদ সৃষ্টি হবে, সেসঙ্গে মহাপরিকল্পনা গ্রহণের তাগিদও অনুভব হবে। বিষয়টি নিয়ে সিডিএলজি(সেন্টার ফর ডেমোক্রেটিক লোকাল গভার্ন্যান্স) দীর্ঘদিন যাবৎ ক্যাম্পেন করে আসছে। সিডিএলজি মনে করে, বর্তমানে গ্রামীণ-নগরীয় সমাজের জন্য উপযুক্ত সরকার ব্যবস্থা থাকতে হবে। সমস্ত জনগণকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করার স্বার্থে দুই প্রকারের সরকার ব্যবস্থা, তথা কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থা ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বটম-আপ(নিচ থেকে উপরমুখী) পদ্ধতিতে চালু করতে হবে। সেজন্য জেলা কিংবা বিভাগকে (যদি বিভাগকে প্রয়োজনীয় মনে হয়) সর্বোচ্চ ইউনিট ধরে স্থানীয় সরকারের স্তরবিন্যাস করতে হবে। প্রতিটি স্থানীয় ইউনিটকে স্বনির্ভর ও স্বশাসিত করার স্বার্থে প্রজাতান্ত্রিক রূপ দিতে হবে। যেমন- ইউনিয়ন সরকার, নগর সরকার, উপজেলা সরকার, জেলা সরকার ইত্যাদি। জেলা সরকারের অধীনে একদিকে গ্রামীণ ইউনিটগুলো, অন্যদিকে নগরীয় ইউনিটগুলো পরিচালিত হবে। উপজেলার আয়তনের মধ্যে কোনো নগরীয় ইউনিট থাকবে না। নগরীয় ইউনিটের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং সে কারণে উপজেলার আয়তন হ্রাস পেতে পেতে ২০৫০ সাল নাগাদ উপজেলাগুলোর বিলুপ্তি ঘটবে। সমগ্র দেশটি তখন প্রয়োজনীয় সংখ্যক নগরীয় ইউনিটে বিভক্ত হয়ে পড়বে।
সংক্ষেপে নগর সরকারের রূপরেখা উল্লেখ করা যেতে পারে। নগর প্রশাসন, নগর সংসদ আর নগর আদালত মিলে ‘নগর সরকার’ গঠিত হবে। নগর সংসদ নগর কেন্দ্রিক আইন-কানুন ও উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও পাশ করবে( বর্তমানে কাউন্সিলর আছেন, কিন্তু ‘কাউন্সিল’ নেই)। নগর সংসদের জন্য সমহারে নারী-পুরুষ নির্বাচিত হবেন। নগর সংসদে পাশকৃত প্রস্তাবসমুহ নগর প্রশাসন বাস্তবায়ন করবে। নগর আদালতে একজন পৃথক বিচারক থাকবেন, তিনি নগর সংসদ ও নগর প্রশাসনের সংগে জড়িত থাকবেন না। নগর আদালত নগর কেন্দ্রিক অপরাধ কর্মকাণ্ড ও পারিবারিক বিরোধের বিচার করবেন। নগর সরকারের বাইরে নগর নির্বাচনিক বোর্ড ও নগর ন্যায়পাল থাকবে। নগরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ‘নগর নির্বাচনিক ‘ গঠিত হবে। নগর নির্বাচনিক বোর্ড সম্পুর্ণ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নগরের নির্বাচন সম্পন্ন করবে। সর্বদলীয় ও সর্বজনগ্রাহ্য একজন ব্যক্তি ন্যায়পাল পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন। ন্যায়পাল নগর প্রশাসন ও নগর সাংসদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ নিষ্পত্তি করবেন। একই রকম সরকার ব্যবস্থা অন্যান্য ইউনিটগুলোতেও থাকবে। যদি এরকম শাসন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়, তাহলে সমগ্র দেশটি পরিবেশ বান্ধব পরিকল্পিত নগর ও নগরায়নের দিকে যাত্রা শুরু করবে। সেসঙ্গে দেশটিকে সকলে আমাদের ভাবতে শুরু করবে, স্বাধীনতা অর্থবহ হবে, সকলের মধ্যে মালিকানা বোধ জাগ্রত, সকলে সিভিক সেন্সের অধিকারী হয়ে যাবে – তাতে কোনো সন্দেহ থাকার কারণ নেই।