সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা কোটা সংস্কার আন্দোলনের ভিত্তিতে কোটা ব্যবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গতকাল সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে আন্দোলনটির প্রতিনিধি দলের বৈঠক শেষে ৭ মে পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত করেছে ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’। বৈঠক শেষে পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন।
কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলন বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে সচিবালয়ে এ বৈঠক হয়।
এর আগে মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিষয়টি আলোচনা হয়। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি নিয়ে একটা সমাধান খুঁজে পাওয়ার জন্য এরই মধ্যে মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর বিশেষ বৈঠকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।’
সোয়া দুই ঘণ্টা আলোচনার পর আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধিদের পাশে নিয়ে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘সরকার রিজিড অবস্থানে নেই। আমি তাদের আশ্বস্ত করেছি। তাদের দাবির যৌক্তিকতা আমরা ইতিবাচকভাবেই দেখব। ৭ মে’র মধ্যে সরকার রিভিউ বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে। রেজাল্ট কী আসে, আমরা সেটা জানিয়ে দেব। তারা কথা দিয়েছে, ওই পর্যন্ত তারা তাদের চলমান আন্দোলন স্থগিত রাখবে।’
এর আগে ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন কোটা সংস্কারের বিষয়টি আমলে নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘আগামী মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আমাদের এ আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করা হল। এখন পর্যন্ত আমার যেসব ভাইবোন গ্রেফতার হয়েছেন, তাদের নিঃশর্তভাবে মুক্তি দেয়া হবে। যারা আহত হয়েছেন, তাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করবে সরকার।’
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রোববার রাতে সংঘাত চলাকালে ভিসির বাসভবনে তাণ্ডবের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের ‘শাস্তি পেতে হবে’ বলে সভা শেষে সাফ জানিয়ে দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘গতকাল (রোববার মধ্যরাতে) ভিসির বাসভবনে তাণ্ডব চলেছে। ভিসির পরিবারকে বাগানে পালিয়ে থাকতে হয়েছে। সেখানকার ভিডিও ফুটেজ থেকে এই তাণ্ডবের সঙ্গে যারা জড়িত বলে প্রমাণিত হবে, তাদের শাস্তি পেতে হবে। আমি আন্দোলনকারী মেধাবী তরুণদের প্রশ্ন করেছি, কোটা সংস্কারের সঙ্গে ভিসির সম্পর্ক কী? কোটার সঙ্গে তো তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তিনি ও তার বাসভবন, তার পরিবার কেন আঘাত পাবে? আন্দোলনকারীরা একমত হয়েছে, কিছু অনুপ্রবেশকারী, বহিরাগত ও সন্ত্রীরা এ কাজ করে থাকতে পারে। এখানে ডিএমপি কমিশনার আছেন। তিনি দেখবেন, নিরীহ কেউ যেন গ্রেফতার না হয়। যারা সত্যিকার অর্থে তাণ্ডব চালিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধেই যেন অ্যাকশন নেয়া হয়।’ যারা এ আন্দোলনে বিভিন্নভাবে আহত হয়েছেন, তাদের সুচিকিৎসায় সরকার কোনো কার্পণ্য করবে না বলেও জানান তিনি। তিনি আরও বলেন, ‘আমি পুলিশ কমিশনারকে বলেছি, নিরীহ কাউকে যেন ধরা না হয়।’
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘তরুণরা এ কোটা সংস্কার আন্দোলন করছে। তারা আমাদের রাজনীতির অপরিহার্য অংশ, তারাই নতুন প্রজন্ম। আমরা এই পরবর্তী প্রজন্মের জন্যই রাজনীতি করি। তাই শেখ হাসিনার সরকার কখনও তরুণদের যৌক্তিক দাবিকে উপেক্ষা করেনি। সেই ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকেই প্রধানমন্ত্রী আমাকে পাঠিয়েছেন। আমার সঙ্গে সহকর্মীরা আছেন। আন্দোলনকারীদের ২০ জনের প্রতিনিধি এখানে এসেছেন। তাদের বক্তব্য আমরা শুনেছি।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, ‘বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি নিয়ে একটা সমাধান খুঁজে পাওয়ার জন্য এরই মধ্যে মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিশেষ বৈঠকের নির্দেশ দিয়েছেন। কয়েক মিনিট আগেও প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেছেন, তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কোটা পদ্ধতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ বিষয়টিতে সরকার রিজিড অবস্থানে নেই। আমি আন্দোলনকারীদের আশ্বস্ত করেছি, তাদের দাবির যৌক্তিকতা আমরা ইতিবাচকভাবে দেখব।’
বর্তমানে দেশে পাঁচ শতাংশ কোটা রাখা হয়েছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য, প্রতিবন্ধী এক শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী ও জেলা কোটা ১০ শতাংশ করে। সব মিলিয়ে কোটার জন্য বরাদ্দ ৫৬ শতাংশ। ফলে এর কোনো শ্রেণীতে যারা পড়েন না, তাদের প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে বাকি ৪৪ শতাংশের জন্য। এ পদ্ধতি সংস্কারে পাঁচ দফা দাবিতে ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’র ব্যানারে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। তাদের দাবিগুলো হল- সরকারি নিয়োগে কোটার পরিমাণ ৫৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা, কোটার যোগ্য প্রার্থী না পেলে শূন্যপদে মেধায় নিয়োগ, কোটায় কোনো ধরনের বিশেষ নিয়োগ পরীক্ষা না নেয়া, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে অভিন্ন বয়সসীমা, নিয়োগ পরীক্ষায় একাধিকবার কোটার সুবিধা ব্যবহার না করা।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, এনামুল হক শামীম, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আফজাল হোসেন, সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, মুক্তযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, উপদফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য এসএম কামাল হোসেন, ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া উপস্থিত ছিলেন। আর মামুনের নেতৃত্বে বৈঠকে পরিষদের ২০ সদস্যের মধ্যে কানিজ ফাতেমা, আফসানা সাফা, একরামুল হক, আল ইমরান হোসাইন, লীনা মিত্র, আরজিনা হাসান, লুবনা জাহান প্রমুখ ছিলেন।
এ বৈঠকের আগে মন্ত্রিসভার বৈঠকের সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, সরকারি চাকরির বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে দেশব্যাপী শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আজ কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি, কিছুটা অনির্ধারিত আলোচনা হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবে, দেখে এটা অবহিত করবে।’ এক সাংবাদিক মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে বলেন, কোটায় নিয়োগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্প্রতি যে পরিপত্র দিয়েছে, তারপরই নতুন করে এ আন্দোলন শুরু হয়েছে। এ সময় শফিউল আলম বলেন, ‘পরিপত্রটা আমরা পরীক্ষা করে দেখব।’
কোটার কারণে মেধাবীরা ‘খুব বেশি বঞ্চিত হয়নি’ দাবি করে গত তিনটি বিসিএসের নিয়োগে কত শতাংশ মেধাবী নিয়োগ পেয়েছেন, সেই তথ্য তুলে ধরেন শফিউল আলম। তিনি বলেন, ‘৩৩তম বিসিএসের ৭৭ দশমিক ৪০ শতাংশ পদ মেধা কোটা দিয়ে পূরণ করা হয়েছে। ৩৫তম বিসিএসে ৬৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ এবং ৩৬তম বিসিএসে ৭০ দশমিক ৩৮ শতাংশ পদ মেধা থেকে পূরণ হয়েছে। মেধা কোটা কখনও অবহেলিত হয় না। এমন নয় যে যারা মেধাবী, তারা অবহেলিত হয়ে যাচ্ছে, পেছনে পড়ে যাচ্ছে। জেলা কোটার ক্ষেত্রেও তা-ই। জেলার মধ্যে যারা ভালো করবে, তারা আসবে। প্রত্যেক সেক্টরেই মেধার মধ্যে যারা অগ্রসর, তারাই আসবে। কোটা দ্বারা কিন্তু কারও মেধা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।’
মুক্তিযোদ্ধা কোটায় যখন যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছে না, তখন সেসব পদ অন্যভাবে পূরণ করা হচ্ছে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। তিনি বলেন, ‘মন্ত্রিসভার সোজা সিদ্ধান্ত ছিল কোটায় যদি যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না যায়, মেধা তালিকার শীর্ষে অবস্থানকারীদের দিয়ে তা পূরণ করা হবে। পদ না পাওয়া গেলে মেধা তালিকার উপরের দিকে যারা আছে তাদের দিয়ে পূরণ করা হবে, এটাও তো সংস্কার। একটা সংস্কার অলরেডি হয়ে গেছে। এতে মোধাবীরা যথেষ্ট স্কোপ পাচ্ছে বলে আমাদের ধারণা। কোটার কারণে যারা মেধাবী, তারা খুব বেশি বঞ্চিত হয়নি।’
দেশব্যাপী চলমান এ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে কোটা নিয়ে সরকার নতুন করে ভাববে কি না, এ প্রশ্নে শফিউল বলেন, ‘শুধু মেধা যদি হয়, তাহলে অনগ্রসর জেলাগুলো তাদের জন্য যে জেলা কোটা রাখা আছে, সেখানে তারা একসেস পাবে না, এটা তো বুঝতে হবে। মহিলা, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, প্রতিবন্ধীরা পাবে না। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মেধার কনটেস্ট হচ্ছে। তাদের মধ্যে যারা মেধায় অগ্রসর, উপরের দিকে তারাই তো আসবে। এখানে মেধাকে আন্ডারমাইন করা হচ্ছে না।’