Connect with us

মতামত

নগরীয় বাংলাদেশের জন্য মাইন্ডসেট পাল্টাতে হবে

Published

on

মানসজগত গঠনের ক্ষেত্রে স্মৃতি বড় ভুমিকা পালন করে। সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, মানবকুল প্রায় ১১ হাজার বছর পুর্বে গ্রামীণ(কৃষিজ) জীবন শুরু করে। শিল্প বিপ্লবের পর দেশের একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী নগরে বসবাস আরম্ভ করে। বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী নগরে বসবাস করছে। এদেশেও নগরে বসবাসকারী লোকের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মানসজগতে রয়ে গেছে গ্রামীণ সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব।আমাদের গল্প-উপন্যাস- সিনেমা সবই গ্রামীণ জীবনকে কেন্দ্র করে রচিত। ফলে আমরা নগরীয় সভ্যতাকে অকুণ্ঠ চিত্তে স্বাগত জানাতে পারছি না। তাছাড়া আমাদের বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশ মনে করেন-‘গ্রামকে শোষণ করে শহর গড়ে উঠেছে। শহরে শোষকরা বসবাস করে।’

তাদের এই ধারণার পিছনে যুক্তি আছে; তাঁরা দেখে আসছেন নগরকে ঘিরেই যাবতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। শহরেই সকল নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। কিন্তু বিলম্বে হলেও সরকার গ্রামে নগরীয় সুযোগ-সুবিধা দেয়ার জন্য বহু প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। আমরা ভুলে যাই যে, গ্রামের উন্নয়ন হওয়া মানেই ‘নগর’ হয়ে যাওয়া। তাছাড়া বর্তমান সরকার ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ নামক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তবে বর্তমান বাংলাদেশ পুরোপুরি গ্রামও নয়, পুরোপুরি নগরও নয়। সেকারণে আমাদের মাঝে গ্রামীণ-নগরীয় সংস্কৃতির প্রভাব লক্ষ্যনীয়। একই কারণে সমগ্র দেশে এক ধরণের ক্ষতিকর অস্থিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাংলাদেশে নগরায়নের ধারণা প্রথমে নিয়ে আসেন নিউইয়র্ক প্রবাসী গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের প্রবক্তা আবু তালেব।

তিনি ১৯৯৭ সালে ১৩ জানুয়ারি ঢাকা যাদুঘরে অনুষ্ঠিত ” স্থানীয় সরকারঃ গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত’ শীর্ষক এক সেমিনারে বলেন -বর্তমান বাংলাদেশকে গ্রামীণ বাংলাদেশ বলা ঠিক হবে না, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে গ্রামীণ- নগরীয় দেশে অনুপ্রবেশ করেছে। ২০২০ সালে বাংলাদেশে প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী এবং ২০৫০ সালে পুরো জনগোষ্ঠী নগরে বসবাস করবে। উল্লিখিত সেমিনারে তিনি স্থানীয় সরকারের স্তরবিন্যাস করে দেখান যে, তিন ধরণের স্থানীয় সরকার বিদ্যমান রয়েছে ; যথা-গ্রামীণ সরকার, গ্রামীণ-নগরীয় স্থানীয় সরকার আর নগরীয় স্থানীয় সরকার। ইউনিয়ন পরিষদ সমুহ, আর যেসব উপজেলার আয়তনে পৌরসভা নেই সেগুলো গ্রামীণ ইউনিট, যেসব উপজেলার আয়তনে পৌরসভা আছে সেগুলো ও জেলাগুলো গ্রামীণ-নগরীয় ইউনিট এবং পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডগুলো নগরীয় ইউনিট। তবে সরকারের বিভিন্ন দফতর ও পাঠ্যপুস্তকে দুই প্রকারের স্থানীয় ইউনিটের কথা উল্লেখ আছে তথা, গ্রামীণ ইউনিট ও নগরীয় ইউনিট। গ্রামীণ-নগরীয় বাংলাদেশ ভবিষ্যতে কীভাবে নগরীয় বাংলাদেশে রূপান্তরিত হবে সে বিষয়ে একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।

যেমন-বর্তমানে ৩৮% জনগোষ্ঠী নগরে বসবাস করে। এ ধারা বজায় থাকলে ২০৩০ সালে ৫৫% এবং ২০৫০ সালে ৭৫% জনগোষ্ঠী নগরে বসবাস করবে। সে কারণে কৃষি পেশায় নিয়োজিত লোকের সংখ্যা কমতে থাকবে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ৮৫% লোক কৃষি পেশায় জড়িত ছিল, বর্তমানে ৪০% লোক কৃষি পেশায় জড়িত আছে। নিত্য-নতুন প্রযুক্তি আবিস্কারের কারণে কৃষি পেশার শ্রমশক্তি দ্রুত হ্রাস পেতে থাকবে এবং অনেকে মনে করেন ২০৫০ সাল নাগাদ মাত্র ২০% থেকে ২২% শ্রমশক্তি কৃষি পেশায় নিয়োজিত থাকবে। অর্থাৎ কৃষিতে শুধু দক্ষ শ্রমিকরাই টিকে থাকবে। সেজন্য অদক্ষ কৃষি শ্রমিকদের অকৃষি পেশায় কর্মসংস্থানের জন্য এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। বর্তমানে সমগ্র দেশে প্রায় ২০ হাট-বাজার রয়েছে। হাট-বাজার কেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যে যারা জড়িত আছেন, তারা সকলেই অকৃষি পেশার লোক। ভবিষ্যতে এসব হাট-বাজারকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন নগর সৃষ্টি হবে। এসব হাট-বাজারে ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারে শিল্পকারখানা স্থাপন সহ বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য আরম্ভ করা সম্ভব হলে অদক্ষ কৃষি শ্রমিকরা বাড়ির কাছেই কর্মসংস্থান পেয়ে যাবে। আশার কথা, বর্তমান সরকার সম্প্রতি হাট-বাজার কেন্দ্রিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।

সেজন্য সকল রাজনৈতিক দলকে নগর সভ্যতাকে স্থায়ী সভ্যতা হিসেবে মেনে নিতে হবে। তাহলে এর প্রতি দরদ সৃষ্টি হবে, সেসঙ্গে মহাপরিকল্পনা গ্রহণের তাগিদও অনুভব হবে। বিষয়টি নিয়ে সিডিএলজি(সেন্টার ফর ডেমোক্রেটিক লোকাল গভার্ন্যান্স) দীর্ঘদিন যাবৎ ক্যাম্পেন করে আসছে। সিডিএলজি মনে করে, বর্তমানে গ্রামীণ-নগরীয় সমাজের জন্য উপযুক্ত সরকার ব্যবস্থা থাকতে হবে। সমস্ত জনগণকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করার স্বার্থে দুই প্রকারের সরকার ব্যবস্থা, তথা কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থা ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বটম-আপ(নিচ থেকে উপরমুখী) পদ্ধতিতে চালু করতে হবে। সেজন্য জেলা কিংবা বিভাগকে (যদি বিভাগকে প্রয়োজনীয় মনে হয়) সর্বোচ্চ ইউনিট ধরে স্থানীয় সরকারের স্তরবিন্যাস করতে হবে। প্রতিটি স্থানীয় ইউনিটকে স্বনির্ভর ও স্বশাসিত করার স্বার্থে প্রজাতান্ত্রিক রূপ দিতে হবে। যেমন- ইউনিয়ন সরকার, নগর সরকার, উপজেলা সরকার, জেলা সরকার ইত্যাদি। জেলা সরকারের অধীনে একদিকে গ্রামীণ ইউনিটগুলো, অন্যদিকে নগরীয় ইউনিটগুলো পরিচালিত হবে। উপজেলার আয়তনের মধ্যে কোনো নগরীয় ইউনিট থাকবে না। নগরীয় ইউনিটের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং সে কারণে উপজেলার আয়তন হ্রাস পেতে পেতে ২০৫০ সাল নাগাদ উপজেলাগুলোর বিলুপ্তি ঘটবে। সমগ্র দেশটি তখন প্রয়োজনীয় সংখ্যক নগরীয় ইউনিটে বিভক্ত হয়ে পড়বে।

সংক্ষেপে নগর সরকারের রূপরেখা উল্লেখ করা যেতে পারে। নগর প্রশাসন, নগর সংসদ আর নগর আদালত মিলে ‘নগর সরকার’ গঠিত হবে। নগর সংসদ নগর কেন্দ্রিক আইন-কানুন ও উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও পাশ করবে( বর্তমানে কাউন্সিলর আছেন, কিন্তু ‘কাউন্সিল’ নেই)। নগর সংসদের জন্য সমহারে নারী-পুরুষ নির্বাচিত হবেন। নগর সংসদে পাশকৃত প্রস্তাবসমুহ নগর প্রশাসন বাস্তবায়ন করবে। নগর আদালতে একজন পৃথক বিচারক থাকবেন, তিনি নগর সংসদ ও নগর প্রশাসনের সংগে জড়িত থাকবেন না। নগর আদালত নগর কেন্দ্রিক অপরাধ কর্মকাণ্ড ও পারিবারিক বিরোধের বিচার করবেন। নগর সরকারের বাইরে নগর নির্বাচনিক বোর্ড ও নগর ন্যায়পাল থাকবে। নগরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ‘নগর নির্বাচনিক ‘ গঠিত হবে। নগর নির্বাচনিক বোর্ড সম্পুর্ণ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নগরের নির্বাচন সম্পন্ন করবে। সর্বদলীয় ও সর্বজনগ্রাহ্য একজন ব্যক্তি ন্যায়পাল পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন। ন্যায়পাল নগর প্রশাসন ও নগর সাংসদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ নিষ্পত্তি করবেন। একই রকম সরকার ব্যবস্থা অন্যান্য ইউনিটগুলোতেও থাকবে। যদি এরকম শাসন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়, তাহলে সমগ্র দেশটি পরিবেশ বান্ধব পরিকল্পিত নগর ও নগরায়নের দিকে যাত্রা শুরু করবে। সেসঙ্গে দেশটিকে সকলে আমাদের ভাবতে শুরু করবে, স্বাধীনতা অর্থবহ হবে, সকলের মধ্যে মালিকানা বোধ জাগ্রত, সকলে সিভিক সেন্সের অধিকারী হয়ে যাবে – তাতে কোনো সন্দেহ থাকার কারণ নেই।

Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

মতামত

ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আনন্দ মোহন কলেজে আনন্দ র‍্যালি

Published

on

By

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজের ছাত্রলীগের আনন্দ র‍্যালি অনুষ্ঠিত হয়েছে।

সোমবার সকালে আয়োজিত র‍্যালিটি আনন্দ মোহন কলেজের ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করেন। এ সময় আনন্দমোহন কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক মো. নাজমুল ইসলাম সাকিব নেতৃত্ব দেন।

এ সময় তিনি বলেন, জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখা হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করে যাবে ও শেখ মুজিবের আদর্শে কাজ করে যাবে ছাত্রলীগের প্রতিটি ইউনিট। সকল অপশক্তিকে রোধকল্পে আনন্দ মোহন কলেজ ছাত্রলীগ ইউনিট সবসময় প্রস্তুত রয়েছে বলে জানান তিনি।

Continue Reading

মতামত

আমি মনোনয়ন নিয়ে ষড়যন্ত্রের শিকার : বিদ্যুৎ কুমার রায়

Published

on

By

নিজস্ব সংবাদদাতা:
দ্বিতীয় ধাপে ইউপি নির্বাচনে পীরগাছার তাম্বুল ইউনিয়নে দলীয় মনোনয়ন পেয়েও একটি কুচক্রী মহল সেটি বাতিল করতে গভীর ষড়যন্ত্র করছে বললেন বিদ্যুৎ কুমার রায়।

শুক্রবার (১৫ অক্টোবর) সন্ধ্যা সাতটার দিকে নেকমামুদ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘বিদ্যুৎ কুমার রায়ের দলীয় মনোনয়ন নিয়ে চক্রান্তের বিরুদ্ধে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে’ সাংবাদিকের এসব কথা বলেন তিনি।

প্রতিবাদ সমাবেশে বিদ্যুৎ কুমার রায় বলেন, গত ৭ অক্টোবর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের চেয়ারম্যান প্রার্থীদের দলীয় মনোনয়ন চূড়ান্ত করেছে আওয়ামী লীগ। সেখানে পীরগাছা উপজেলার আটটি ইউনিয়নের মধ্যে তাম্বুলপুরে আমাকে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

“সেই মনোনয়ন নিয়ে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিতরা আমার মনোনয়ন বাতিল করতে ষড়যন্ত্র করছে। আমি মনোনয়ন পেয়ে কাগজপত্র দাখিল করতে প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলাম। এমন সময়ে বৃহস্পতিবার (১৪ অক্টোবর) রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখলাম প্রার্থী পরিবর্তন করে আমার স্থলে ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহিন সরদারকে দল নতুন করে নৌকার মনোনয়ন দিয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন পোষ্ট দেখে আমি উপজেলা নির্বাচন কমিশন অফিস এবং মাননীয় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি মহোদয়ের কাছে বিষয়টি ক্লিয়ার হতে জানার চেষ্টা করি কিন্তু পরিস্কার কোন উত্তর পাই নাই। এছাড়াও প্রার্থীতা বাতিলেরও কোন চিঠি এখন পর্যন্ত হাতে পাইনি। তাই যারা আমার এই মনোনয়ন নিয়ে ষড়যন্ত্র করে আমার ইউনিয়নের ভোটারদের বিভ্রান্ত করছে তাদের প্রতি দলীয় হস্তক্ষেপের দাবি জানান তিনি।

উপজেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি আব্দুল কুদ্দুস ভূঁইয়ার সভাপতিত্বে প্রতিবাদ সমাবেশে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন, তাম্বুলপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ জসিম উদ্দিন, উপজেলা হিন্দু বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদের সভাপতি শ্রী ভবেশ চন্দ্র বর্মন, উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আবু তারেক পাভেল। ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আলী, মোতাকাব্বার হোসেন বাপন প্রমুখ।

Continue Reading

মতামত

স্যোশাল মিডিয়া: নিজেকে মিথ্যেভাবে জাহির করার এক অবিরাম প্রতিযোগিতা

Published

on

By

সবুজ ভট্টাচার্য্য
বাঙ্গালীদের মন-মানসিকতা সার্বিক পর্যালোচনার মাধ্যমে কোন একটি নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছানো বেশ কষ্টসাধ্য বিষয়। আবেগ তাড়িত এই জাতিকে শিক্ষার মাধ্যমে খুব বেশি পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি। এর প্রভাব পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। “নিজে যারে বড় বলে বড় সেই নয়, লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়” – এটি খুবই প্রচলিত একটি বাংলা প্রবাদ যা আত্মসংযমের উদ্দেশ্যে প্রণিত হলেও পরবর্তীতে সেই আত্মসংযম তীব্র গতিতে বেড়ে গিয়ে বাঙালি মন থেকে সম্পূর্ণ বিয়োজন হয়ে গেছে।

ব্রিটিশ আমলে হাজার বছরের ধুতি পাঞ্জাবি ছেড়ে ইংরেজদের সুট বুট পড়া শুরু করা থেকেই এই জাতি নিজেকে মিথ্যেভাবে জাহির করা শুরু করে। কিন্তু সেই মিথ্যে ভাবে জাহির করার বিষয়টি যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলে এলো তখন তা অতীতের সব সীমাকেই লংঘন করেছে। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অধিকাংশ মানুষ নিজেকে মিথ্যেভাবে উপস্থাপন করছে। এর ক্ষেত্র এবং উদ্দেশ্য রীতিমত একটি গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সর্বপ্রথম যে বিষয়টি আমাদের চোখে পড়ে তা হল অধিকাংশ ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের সাজসজ্জা বা মেকাপের আড়ালে ঢেকে নিজেকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে এক ধরনের তৃপ্তি অনুভব করছেন। এক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উপস্থাপিত নিজের ছবিতে এসবের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের এডিটিং সফটওয়্যার ব্যবহারের ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে ভাবে ঐ ব্যাক্তি উপস্থাপিত হচ্ছে তার সাথে প্রকৃত ব্যাক্তির অধিকাংশই ক্ষেত্রেই মিল খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।

যার কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সূত্র ধরে সৃষ্ট সকল সম্পর্ক খুব বেশিদিন স্থায়িত্ব পাচ্ছে না। কারণ এ ধরনের মিথ্যে আবরণে ঢাকা ব্যক্তি সমূহকে বাস্তব জীবনে প্রত্যক্ষভাবে পাওয়ার পর সেই ব্যক্তির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সার্বিক অবয়বের সাথে তার বাস্তব জীবনের প্রকৃত রূপের মিল না পাওয়ার কারণে তার সম্পর্কে পূর্বে যে সম্মানবোধ বা আকর্ষণ কাজ করতো তা খুব অল্প সময়ে বাষ্প হয়ে উড়ে যায় এবং সম্পর্কগুলোতে আকস্মিক পরিবর্তন আসে।

সৌন্দর্যের সংজ্ঞা এর ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে আদিকাল থেকেই একটি বিভ্রান্তি রয়েছে যা একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এই জাতি ভুলতে পারেনি এবং তার রক্ত থেকে দূরীভূত করতে পারেনি। এই লেখার বিষয়বস্তুর প্রয়োজনেই একজন আমেরিকান লেখক এবং সাংবাদিক নাওমি ওল্ফের লেখা একটি বইয়ের কিছু তথ্য তুলে ধরছি। “মিথ অফ বিউটি” নারীবাদী তত্ত্বের উপর লেখা একটি ক্লাসিক রচনা, মূলত ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে এটি লেখা হয়েছিল । এতে, লেখক বহু অধ্যয়ন এবং গবেষণার উপর ভিত্তি করে, নারী মুক্তি, নারীর অগ্রগতি এবং সৌন্দর্য সম্পর্কে মানুষের ক্রমবর্ধমান বিভ্রান্তির উপর আলোকপাত করেছেন।এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার করে বলা উচিত যে “মিথ অফ বিউটি” এর উল্লেখের মাধ্যমে আমি কোনভাবেই সরাসরি নারীদেরকে আমার লেখার একমাত্র বিষয়বস্তু হিসেবে প্রতীয়মান করতে রাজি নই বরং লেখার প্রয়োজনেই এর আবির্ভাব হয়েছে।

অধিকাংশ সময় আমরা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আমাদের ফিকে বা স্বল্পমেয়াদী মনোভাব পোষণ করে থাকি কারণ এই মনোভাবের দীর্ঘমেয়াদে যখন তা নিজের ব্যক্তিগত জীবনের সাথে সাংঘর্ষিক অবস্থান গ্রহণ করে তখন তা থেকে আমরা নিরবে সরে আসি। এখন প্রশ্ন হলো বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আমরা যে এত কথা বলি তা কি প্রকৃত অর্থে আমরা নিজেরা বিশ্বাস করি? অনেকেই বলে থাকেন যে মানুষ সমাজে শ্বেতাঙ্গদের অনেক বেশি দাম দিয়ে থাকেন যেসব ব্যক্তির গায়ের রং ভালো তাদেরকে অনেক বেশি দাম দিয়ে থাকেন এবং যাদের গায়ের রং শ্যামলা বা কাল তারা অনেক ক্ষেত্রেই সমাজে তাদের উপযুক্ত জায়গা গড়ে তুলতে পারেননা এবং সবক্ষেত্রে সমান প্রাধান্য পাননা; যেটাকে তারা এক ধরনের অসম্মান হিসেবে বিবেচনা করেন। আমিও তাদের সাথে একমত কিন্তু একটি জায়গায় আমি কোনোভাবেই একমত হতে পারিনা যে তারা যখন নিজেদেরকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের প্রকৃত রূপকে ভিন্নভাবে প্রদর্শনের চেষ্টায় রত থাকেন।

এতে একটি প্রশ্ন থেকেই যায় যে, তারা কি নিজেরা এই বর্ণবাদের অপবাদে নিজেদেরকেই আঘাত করছে না। কারন তারা নিজেরাই তাদের সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত শারীরিক অবস্থাকে বিভিন্ন ভাবে পরিবর্তন করে সেইসব সাদা চামড়ার মানুষ বা সমাজের চোখে তথাকথিত সুন্দর মানুষ গুলোর মত করতে চাচ্ছে। এতে কি তারা তাদের নিজেদেরকে অপমান করছে না? এটাও যদি একটা অধিকার হিসেবে বিবেচিত হয় তাহলে সমাজকে আলাদা করে দোষ দেবার মত কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। যতদিন না পর্যন্ত তারা তাদের এই ধরনের আচরণ পরিবর্তন করবে না ততদিন পর্যন্ত সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলান সম্ভব নয়। প্রত্যেকটা মানুষ যদি নিজে নিজের শারীরিক অবয়বকে স্বাভাবিক এবং সুন্দর হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে এবং উপস্থাপন করতে লজ্জাবোধ না করে তবেই সেই অবয়ব বা শারীরিক রূপ একসময় গিয়ে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হিসেবে সমাজে বিবেচিত হবে।

আমি মনে করি আমাদের সবসময় নিজেদেরকে একটু কম প্রদর্শন করা উচিত। আমরা ঠিক যতটা; প্রদর্শন করা উচিৎ ঠিক তার অর্ধেক। কারণ আমরা যদি ব্যক্তিগতভাবে আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য, রূপ এবং আমাদের ব্যক্তিগত অবস্থান সব সময় জাহির করতে চাই, তাহলে তা সাময়িক ভাবে লোকমনে দাগ কাটলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা বিরক্তির কারণ হতে পারে এবং ব্যক্তিগতভাবে জাহির করা একশটি তথ্য থেকে যদি একটিও ভুল প্রমাণিত হয় তাহলে ঠিক সেইসব ব্যক্তি যারা আমাদের জাহির করা তথ্য শুনে বা দেখে ঠিক যতটা আমাদেরকে দেবতাতুল্য মনে করে মাথায় তুলে রেখেছিল; ঠিক সেই অবস্থান থেকেই মাটিতে ছুঁড়ে ফেলতে একমুহূর্ত দ্বিধাবোধ করবে না। তারচেয়ে বরং আমাদের উচিত নিজেদেরকে কম প্রকাশ করা এবং আশেপাশের মানুষগুলোকে নিজ থেকেই আমাদের সম্পর্কে জানার সুযোগ প্রদান করা। তাহলে তারা নিজ থেকে যা জানবে তা সবসময় তারা সত্য হিসেবেই মানবে এবং তার উপর নির্ভর করে আমাদেরকে যে সম্মান করবে তার সব সময় টিকে থাকবে। কামিনী রায়ের ‘অনুকারীর প্রতি’ নামের কবিতায় এই ভিন্ন জীবনদর্শনের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। তিনি অকাতর চিত্তে তার কবিতায় বলেছেন ; “পরের চুরি ছেড়ে দিয়ে আপন মাঝে ডুবে যা রে / খাঁটি ধন যা সেথায় পাবি, আর কোথাও পাবি না রে।”

লেখক :

সম্পাদক, ত্রৈমাসিক ঊষাবার্তা, চট্টগ্রাম।

Continue Reading