নিউজ ডেস্ক:
প্রায় পুরো আফগানিস্তান দখলের এক সপ্তাহ পেরুলেও এখনও সরকার গঠন করতে পারেনি তালেবান। ফলে এক সপ্তাহ ধরে সরকারবিহীন অবস্থার মধ্যে রয়েছে দেশটির প্রায় পৌনে ৪ কোটি মানুষ। জানা যাচ্ছে, আফগানিস্তানের কর্তার আসন নেওয়া তালেবান অন্য সবাইকে নিয়েই সরকার গঠন করতে চাইছে। সেই লক্ষ্যে প্রভাবশালী বিভিন্ন আফগান নেতাদের সঙ্গে তালেবান নেতাদের বৈঠকও চলছে। এছাড়াও দুই দশক আগের চেয়ে অনেকটাই বদলে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে গোষ্ঠীটি।
তবে নানা গোত্র আর উপদলে বিভক্ত আফগানিস্তানে তা করতে গিয়েও বেগ পেতে হচ্ছে গোঁড়া এই গোষ্ঠীর নেতাদের। তালেবানবিরোধী নেতা হিসেবে পরিচিত আহমদ মাসুদ তো হুমকিই দিয়েছেন, ক্ষমতার ভাগাভাগি ঠিকমতো না হলে আবার গৃহযুদ্ধ শুরু হবে। তিন দশক আগে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর গৃহযুদ্ধের মুখে পড়েছিল আফগানিস্তান। তার মধ্যেই মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিল তালেবান।
এরপর পাঁচ বছর তালেবান শাসনে ছিল আফগানিস্তানে। ২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে হামলার পর ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দেওয়ায় আফগানিস্তানে শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর অভিযান, তাতে ক্ষমতা হারায় তালেবান। গত দুই দশক কোনঠাসা হয়ে থাকা তালেবান আমেরিকান সৈন্যদের ফিরে যাওয়ার প্রাক্কালে এক মাসের মধ্যে একের পর এক শহর দখল করতে থাকে।
১৫ অগাস্ট তালেবান যোদ্ধারা কাবুলে ঢুকে পড়লে পালিয়ে যান আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানি। ফলে বিনাযুদ্ধেই রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ নেয় তারা। তবে কাবুল বিমানবন্দর এখনও যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দখল সম্পূর্ণ হওয়ার পর নির্বাসিত তালেবান নেতারা কাতার থেকে আফগানিস্তানে আসতে শুরু করে, যার মধ্যে রয়েছেন দলের সহপ্রতিষ্ঠাতা মোল্লা আব্দুল গনি বারাদার।
কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর তালেবানের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে দলের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেন যে তারা সবাইকে নিয়েই সরকার গঠন করতে চান। তবে বিভক্ত আফগানিস্তানে সেই কাজটি বেশ কঠিন বলেই স্পষ্ট; আর সেই কঠিন কাজটিই করা শুরু করেছেন বারদার, যার স্বাক্ষরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তালেবানের সমঝোতা চুক্তি হয়েছিল।
আফগানিস্তানের সংবাদ মাধ্যম টলোনিউজ জানিয়েছে, শনিবার তালেবানের রাজনৈতিক শাখার নেতারা বেশ কয়েকজন রাজনীতিকের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তার মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই, জাতীয় পুনর্গঠন কমিশনের প্রধান আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ। তালেবানের পক্ষে বৈঠকে ছিলেন শাহাবুদ্দিন দেলাওয়ার, আবদুস সালাম হানাফি, মোল্লা খায়েরুল্লাহ খয়েরখা, আবদুর রহমান ফিদা।
তালেবান মুখপাত্র জবিউল্লাহ রোববার টলোনিউজকে বলেন, “আমাদের রাজনৈতিক শাখার নেতারা কাবুলে অন্য নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কারণ তাদের মতামতদ জানাটা গুরুত্বপূর্ণ।” আলোচনা আরও চলবে জানিয়েই তিনি বলেন, “শিগগিরই সরকার গঠনের ঘোষণা দেওয়া যাবে বলে আমরা আশা করছি।”
আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ তার ফেইসবুকে এক পোস্টে বলেছেন, আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এবং সবাইকে নিয়ে একটি সরকার গঠনের বিষয়ে।
তবে আফগানিস্তানের কিছু নেতা এই ধরনের বৈঠকের সাফল্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। নাহজাত-ই-হামবাস্তাগি আফগানিস্তান পার্টির নেতা সৈয়দ ইশহাক গিলানি টলোনিউজকে বলেছেন, “আমি এই খেলাটা পছন্দ করছি না। কারণ এটা মনে হচ্ছে একজনের খেলা। সবাই নিজেদের আখের গোছাতে চাইছে, জনগণের প্রতি শ্রদ্ধা কেউই দেখাচ্ছে না।”
বলখ প্রদেশে সাবেক গভর্নর আতা মোহাম্মদ নূর হুঁশিয়ার করেছেন, সবাইকে নিয়ে সরকার গঠন না হলে সেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না। যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি, এখনও বহু দূর যেতে হবে। আমরা তাদের (তালেবান) পরীক্ষা নিচ্ছি, আমরা আবার জেগে উঠতে পারি। হয় সঙ্কটের সমাধান করতে হবে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠনের মধ্য নিয়ে, নইলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।”
প্রায় গোটা দেশ দখল করলেও পাঞ্জশির উপত্যকা এখনও তালেবানের নিয়ন্ত্রণেরি বাইরে রয়েছে। ওই অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছেন এক সময়ের মুজাহিদিন নেতা আহমদ শাহ মাসুদের ছেলে আহমদ মাসুদ। ২০০১ সালে আল কায়দার হাতে নিহত হয়েছিলেন শাহ মাসুদ।
পাঞ্জশির দখল করতে শয়ে শয়ে তালেবান যোদ্ধা অভিযান শুরু করেছে বলে গণমাধ্যম জানিয়েছে। কাবুলের উত্তরের এই অঞ্চলটিতেই তালেবান বড় প্রতিরোধের মুখে পড়েছে।
তালেবানের এক টুইটে বলা হয়েছে- “যেহেতু পাঞ্জশির রাজ্যের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ শান্তিপূর্ণ পথে কর্তৃত্ব হস্তান্তরে রাজি হয়নি, তাই ইসলামিক আমিরাতের মুজাহিদরা সেদিকে রওনা হয়েছে।”
আফগান সামরিক বাহিনীকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের নানা সমরাস্ত্র এখন তালেবানের নিয়ন্ত্রণে; এই অভিযানে তা ব্যবহার করা হচ্ছে। এর জবাবে আহমদ মাসুদ তালেবানকে হুঁশিয়ার করে বলেছেন, “এভাবে চললে তালেবান টিকবে না। আফগানিস্তানকে রক্ষায় আমরা প্রস্তুত, তার জন্য রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতে পারি।”
মাসুদ ন্যাশনাল রেজিস্টেন্স ফোর্স অব আফগানিস্তানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার আশ্রয়েই এখন রয়েছেন তালেবানের ভয়ে পালিয়ে যাওয়া আফগানিস্তানের ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ। তার সশস্ত্র বাহিনীকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছিলেন তিনি।
মাসুদ বলেন,“আমরা সোভিয়েত সেনাদের বিরুদ্ধে লড়েছি, তালেবানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সক্ষমতাও আমাদের আছে।” মাসুদের মতো তালেবানবিরোধী আরও দলও রয়েছে আফগানিস্তানে। দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ বাগলানের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি জেলার নিয়ন্ত্রণও তালেবান হারিয়েছে বলে কদিন আগেই খবর আসে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এখনও তালেবানি শাসনের স্বীকৃতি কারা কারা দেবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তালেবানের সঙ্গে চুক্তি করলেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, তালেবান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি চায় কি না, এখন তাদেরকে সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখনও তালেবানকে স্বীকৃতি দেয়নি বলে ইইউ কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লিয়েনকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে রয়টার্স।
তবে কিছুটা নরম সুর দেখিয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। এদিকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কোরেশি কাবুল সফরে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছে টলো নিউজ।
কোরেশি ইতোমধ্যে আফগান পরিস্থিতি নিয়ে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন। তাতেও আফগানিস্তানে সবার অংশগ্রহণে একটি সরকার গঠনের বিষয়ে জোর দেওয়া হয় বলে খবর প্রকাশ হয়েছে।
তালেবান কাবুল দখলের আগেই চীনে একটি প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিল। তালেবান কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর চীন সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, আফগানিস্তানের সঙ্গে দৃঢ় ‘বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক’ সম্পর্কের জন্য চীন প্রস্তুত।
বিশ্বের অনেক দেশ তাদের দূতাবাস বন্ধ করে কূটনীতিক এবং নাগরিকদের আফগানিস্তানে থেকে সরিয়ে নিতে থাকলেও চীন কাবুলে তাদের দূতাবাস খোলাই রেখেছে। তবে গত দুই দশকে আফগানিস্তানে বিপুল বিনিয়োগ করা ভারতের জন্য তালেবান শাসন অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।