Highlights

আবার স্কুলে যেতে চায় রমাকান্তরা

Published

on

ঠাকুরগাঁও: ছোটবেলায় খুব চঞ্চল ছিল রমাকান্ত। দুরন্তপনায় মাতিয়ে রাখত সবাইকে। একদিন বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে পড়ে গেল সে। সেদিন উঠে দাঁড়ালেও ধীরে ধীরে একসময় হারিয়ে ফেলে হাঁটাচলার শক্তি। সেই থেকে বাড়িতেই শুয়ে-বসে দিন কাটছে তার। একই অবস্থা রমাকান্তের মেজ ভাই জয়ন্তরও। আর ছোট ভাই হরিদ্রও ধীরে ধীরে বড় ভাইদের অবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রমাকান্তদের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার বকুয়া ইউনিয়নের বলিহন্দ গ্রামে। বাবার নাম বাদুল সিংহ।

চিকিৎসক জানিয়েছেন, শিশু তিনটি দুরারোগ্য ‘ডুসিনি মাসকুলার ডিসট্রোফি’ রোগে আক্রান্ত। এটি একটি জিনগত রোগ, তবে সংক্রামক নয়। এ রোগে আক্রান্ত রোগী কখনোই সেরে ওঠে না। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি বেশি দিন বাঁচেও না। অবশ্য হরিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবদুল করিম বলেছেন, ‘ওই শিশু তিনটির চিকিৎসার জন্য যা করণীয়, আমরা তা করতে চাই।’

সম্প্রতি বলিহন্দ গ্রামের রমাকান্তদের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির বারান্দায় রমাকান্ত (১৪), জয়ন্ত (১২) ও হরিদ্র (৬) বসা আছে। রমাকান্ত ও জয়ন্তর হাত-পা শুকিয়ে হাড্ডিসার হয়ে গেছে। তবে রমাকান্ত ও জয়ন্তর মতো লক্ষণ দেখা দিলেও হাঁটাচলা করতে পারছে হরিদ্র।

গৃহস্থালির কাজে ব্যস্ত শিশু তিনটির মা কাজলী রানী। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ছেলেদের পরিচর্যা করে যাচ্ছেন তিনি। এর মধ্যেই কথা হয় তাঁর সঙ্গে। কাজলী রানী জানালেন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে হাঁটতে হাঁটতে পড়ে যায় রমাকান্ত। সেদিন উঠে দাঁড়ালেও কিছুদিনের মধ্যে পা দুর্বল হতে শুরু করে তার। স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নেওয়ার পরও রমাকান্তের হাত-পা শুকিয়ে শক্ত হয়ে যেতে থাকে। স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিলেও একপর্যায়ে রমাকান্ত চলাফেরার শক্তি হারিয়ে ফেলে। ধীরে ধীরে শারীরিক ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে। আর চার বছর আগে জয়ন্তও একই রোগে আক্রান্ত হয়। এখন সেও রমাকান্তের মতো চলাফেরার শক্তি পায় না। আর সম্প্রতি হরিদ্রেরও সেই রোগের লক্ষণ শুরু হয়েছে।

মা কাজলী রানী বলেন, ঘর থেকে বের করা আনা, খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে গোসল পর্যন্ত করিয়ে দিতে হয় ছেলেদের। অবস্থা দেখে শিক্ষকেরা তাদের স্কুলে যেতে নিষেধ করে দিয়েছেন। চলাফেরার শক্তি হারিয়ে ফেলার পাশাপাশি এখন কথা বলতেও অসুবিধা হয় রমাকান্ত ও জয়ন্তর। তবু রমাকান্ত বলে, ‘আমি বেড়াতে চাই। কিন্তু পারি না।’ আর জয়ন্ত বলে, ‘চার বছর থেকে আমি এই অবস্থায়। বেড়াতে ইচ্ছা করে, আবার স্কুলে যেতে ইচ্ছা করে।’

কাজ থেকে ফিরে এসে বাদুল সিংহ বললেন, ‘শ্রম দিয়ে সংসার চলে। ছেলেদের কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েছি। নিশ্চিত হয়েছেন ডুসিনি মাসকুলার ডিসট্রোফি রোগ হয়েছে তাদের, যা সম্বল ছিল চিকিৎসায় সব শেষ হয়ে গেছে। চিকিৎসার ব্যয়ভার আর টানা এখন সম্ভব হচ্ছে না। এখন কী করব, ভেবে পাচ্ছি না।’

সম্প্রতি বাদুল সিংহ তাঁর ছেলেদের নিয়ে ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসার জন্য যান। শারীরিক পরীক্ষার পর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসক কর্মকর্তা (আরএমও) মো. আসাদুজ্জামান তাঁদের পরামর্শ দেন।

এ বিষয়ে কথা হয় মো. আসাদুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি জানালেন, ওই তিনটি ছেলেই দুরারোগ্য ‘ডুসিনি মাসকুলার ডিসট্রোফি’ রোগে আক্রান্ত। এটি একটি জিনগত রোগ, তবে সংক্রামক নয়। এ রোগে আক্রান্ত রোগী কখনোই সেরে ওঠে না জানিয়ে তিনি বলেন, এ রোগে আক্রান্ত শিশুদের সাত-আট বছর বয়স থেকে হাঁটতে সমস্যা হয়। একসময় মাংসপেশি জমাট বাঁধতে শুরু করে। এ কারণে একেক সময় শরীরের একেকটা অঙ্গ দুর্বল হতে শুরু করে। একসময় নিস্তেজ হয়ে পঙ্গু হয়ে যায় রোগী। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি বেশি দিন বাঁচে না। আর এ রোগ থেকে সেরে ওঠার কোনো সম্ভাবনা নেই।

এসব রোগীর বেশির ভাগই অপুষ্টিতে ভুগছে জানিয়ে আরএমও আসাদুজ্জামান আরও বলেন, তাদের পুষ্টি খুব দরকার। চিকিৎসা করলে হয়তো একটু আরাম হয়, কিন্তু এ রোগ সেরে যায় না। মাংসপেশি দুর্বল হয়ে যাওয়ায় দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার দরকার হয়, কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয় না। তিনি আরও বলেন, মাংসপেশি দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণে রোগী একসময় চলাফেরার শক্তি হারিয়ে ফেলে। তারপর একসময় মৃত্যু হয়। এ রোগে আক্রান্তরা সর্বোচ্চ ২০ থেকে ৩০ বছর বাঁচতে পারে। রোগটি নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত, রোগের ওষুধ নিয়েও ভাবা দরকার।

আনোয়ার হোসেন আকাশ/ঠাকুরগাঁও

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version