২০০১ সালে আফগানিস্তানের ক্ষমতা হারানো তালেবান যোদ্ধারা ফের দেশটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। রোববার (১৫ আগস্ট) কাবুল দখল করলেও এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার গঠন করেনি তারা। তবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ দেশটিতে অন্তর্ভুক্তি ও সকল জাতি-বর্ণের সমতাভিত্তিক একটি সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানিয়েছে।
তালেবান ক্ষমতায় আসায় ঢাকা-কাবুল সম্পর্কে প্রভাব পড়বে কি না? এমন প্রশ্নে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে এম আব্দুল মোমেন বলে দিয়েছেন, জনগণের সরকার হলে বাংলাদেশ গ্রহণ করবে। তালেবানদের কাবুল বিজয়ের পর দিন সোমবার (১৬ আগস্ট) সাংবাদিকদের কাছে এই মন্তব্য করেন তিনি।
মোমেন বলেন, ‘নতুন যে সরকারই আসুক, সেটা যদি জনগণের হয়, তাহলে আমরা গ্রহণ করব। আমরা জনতার সরকারে বিশ্বাস করি, আমরা গণতান্ত্রিক সরকারে বিশ্বাস করি।’
আফগানিস্তানে হতে যাওয়া নতুন সরকার বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ স্পষ্টই বলা চলে। তবে তারপরও দেশটির বর্তমান পরিস্থিতি বেশ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ। চীন-রাশিয়ার মতো বেশকয়েকটি দেশ তালেবানদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চললেও বাংলাদেশ আগ বাড়িয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না বলেই কূটনৈতিক মহল সূত্রে জানা গেছে।
কূটনীতিকদের অনেকেই বলছেন, বড় শক্তিগুলোর অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে। সাবেক কূটনীতিক মোহাম্মদ জমির বলেন, ‘বর্তমান পৃথিবীতে বড় শক্তিগুলোর সিদ্ধান্ত দ্রুত বদলে যাচ্ছে। তাদের সিদ্ধান্তগুলো আমাদেরকে বুঝতে হবে, তারপর নিজেদের অবস্থান নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
তালেবান উত্থানের প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সময় বদলে গেছে, বাংলাদেশ আগের চেয়েও এখন অনেক বেশি পরিণত। এজন্য এর প্রভাব আমি সেভাবে দেখি না। তবে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। আমরা চাইব না এর কোনো ছায়া এসে বাংলাদেশে পড়ুক।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বলেন, ‘আফগানিস্তানে এখন যে অবস্থা চলছে সেটি দীর্ঘায়িত হলে নিরাপত্তা শূন্যতা তৈরি হবে। মার্কিনিরা ইতোমধ্যেই চলে গেছে। আগের সরকারের পতন হয়েছে। নতুন কোনো সরকার এখনও আসেনি। সেখানে স্বাভাবিক ভাবেই আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা শুরু হবে। এই প্রতিযোগিতা তাদের নতুন সংঘাতের দিকে নিয়ে যেতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘সেখানে নতুন করে যেকোনো সংঘাত শুরু হলে তার প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ায় পড়বে। বিভিন্ন দেশের জঙ্গিরা তালেবানের এই জয়কে নিজেদের জয় হিসেবে দেখছে। উজ্জীবিত হচ্ছে। এই ঝুঁকি বাংলাদেশেও রয়েছে। অতীতে বাংলাদেশে অনেক আফগান ফেরত জঙ্গি সক্রিয় ছিল। এবারও কিছু তরুণ সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। এমন পরিস্থিতি যেন তৈরি না হয়। সে বিষয়ে আগে থেকেই নিরাপত্তা কৌশল তৈরি করে রাখতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘জঙ্গিবাদ বিস্তারের জন্য সবসময় রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা লাগে। যেটি বাংলাদেশে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বাংলাদেশ এখন অনেক বেশি প্রগেসিভ ও আধুনিক। তাছাড়া তালেবান তাদের চরিত্র পাল্টেছে। আগের যুদ্ধের পথ বদলে আলোচনার টেবিল বেছে নিয়েছে। কাতারে বসে দাবি-দাওয়া নিয়ে পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে কূটনীতি করছে। প্রতিবেশিদের সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়নের ঘোষণা দিয়েছে। এটি স্বস্তির। তবে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।’
তবে তালেবানের অতীত ইতিহাস ও কার্যপরিধি পর্যালোচনা করে অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক আশঙ্কা করছেন, উগ্রবাদীরা নতুন করে মাথাচাড়া দিতে চেষ্টা করবে। অপরদিকে, পরিস্থিতি যাই হোক আফগানিস্তানে বাণিজ্য বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন অনেক ব্যবসায়ী। দেশটির সঙ্গে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য পরিমাণের বাণিজ্য না থাকলেও নিরাপত্তা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ব্যবসা বাড়াতে বলেছেন অনেকে। তাদের মতে, উদ্যোক্তাদের জন্য দেশটি সম্ভাবনাময়।
আগের সরকারগুলোর শাসনামলে দেশটিতে বেশ কিছু তৈরি পোশাক কারখানা চালু হয়েছে। এছাড়াও কিছু মধ্যম ও ক্ষুদ্র শিল্পপ্রতিষ্ঠানও সচল রয়েছে কাবুলে। তিন কোটিরও বেশি জনসংখ্যার এই দেশে উৎপাদন খরচও কম। আর এটিকেই ব্যবসার জন্য সম্ভাবনার কারণ বলছেন বিশ্লেষকরা।
তবে ঢাকা-কাবুল বাণিজ্য সম্পর্ক অনেক পুরনো হলেও এখন সেই বাণিজ্যে পরিমাণ অনেক কম। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশ থেকে আফগানিস্তানে রফতানির পরিমাণ ছিল ৬২ লাখ ৬০ হাজার ডলার, আমদানি ৮১ লাখ ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে রফতানি কমে দাড়িয়েছে ৫৭ লাখ ৭০ হজার ডলারে। আমদানি হয়েছে ৯২ লাখ ডলার।
প্রসঙ্গত, তালেবানরা ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর অভিযানে তাদের উৎখাত করা হয়। দীর্ঘ ২০ বছর পর ন্যাটো দেশটি থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নিলে তারা আবারও ফিরে আসে এবং আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে।