ডেস্ক রিপোর্ট:
গত শনিবার টেকনাফ সীমান্তে র্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর একরামুল হক (৪৬)। ইয়াবা ব্যবসার সাথে জরিত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে এই কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে। দেশে যখন প্রতিদিন অসংখ্য মাদক ব্যবসায়ীকে বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করা হয়েছে তখন এ অভিযানকে স্বাগত জানালেও পৌর কাউন্সিলর নিহত হওয়ার পর ক্ষোভে ফুঁসছে পুরো দেশ। কারণ যাকে ইয়াবা ব্যবসার অভিযোগে বন্দুকযুদ্ধে মারা হয়েছে এলাকবাসীর দাবি তিনি ইয়াবা ব্যবসায়ী ছিলেন না। বরং ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন এই জনপ্রতিনিধি।
গতকাল ৩১ মে এক সংবাদ সম্মেলনে এই বন্দুকযুদ্ধকে ঠান্ডা মাথার খুন হিসেবে আক্ষায়িত করেন নিহত একরামুল হকের স্ত্রী আয়েশা বেগম। তখনই তিনি প্রকাশ করেন ৪ টি অডিও ক্লিপ, চারটি ক্লিপ মিলিয়ে ১৪ মিনিট ২২ সেকেন্ডের ওই অডিও রেকর্ডে কয়েকজনের কণ্ঠ, গুলির শব্দ আর চিৎকার সাংবাদিকদের শুনিয়ে একরামের স্ত্রী আয়েশা বেগম অভিযোগ করেছেন, তার স্বামীকে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে ‘পরিকল্পিতভাবে হত্যা’ করা হয়েছে।
এদিকে একরামুল হকের পরিবারের দেওয়া অডিও টেপটি খতিয়ে দেখছে বলে জানিয়েছে র্যাব সদর দফতর। র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান আজ শুক্রবার একথা জানিয়ে বলেন, ‘যে অডিও রেকর্ডের কথা বলা হচ্ছে আমরা তা আমলে নিয়ে খতিয়ে দেখছি’।
অডিও ক্লিপটি-
সেদিন সংবাদ সম্মেলনে আয়েশা বলেন, গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তার ক্রমাগত ফোনের কারনে রাত ৯ টাই সেদিন বেড়িয়ে যান একরাম। রাত ১১ দিকে বাড়ি না ফিরাতে তাকে ফোন করেন মেয়ে । এসময় একরাম তার মেয়েকে জানান তিনি এক মেজরের সাথে হীলা যাচ্ছেন।
যা আছে অডিওতে:
আয়েশার বিবরণ অনুযায়ী, একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তার ক্রমাগত ফোন পেয়ে ২৬ মে রাত ৯টার দিকে একরাম বাড়ি থেকে বের হন। রাত ১১টার সময়ও বাড়ি ফিরে না এলে তার মেয়ে ১১টা ১৩ মিনিটে ফোন করে তার বাবাকে।
অডিওতে শোনা যায়, মেয়ে জানতে চাইছে তিনি কোথায় আছেন। জবাবে বাবা বলেন, ‘মেজর সাহেব’ ডেকেছিলেন, ওখান থেকে তিনি টিএনও (ইউএনও) অফিসে যাচ্ছেন।
টিএনও অফিস থেকে আসতে দেরি হবে কি না- মেয়ের সেই জিজ্ঞাসায় বাবা বলেন, দেরি হবে না। এরপর ফোন কেটে যায়।
রাত ১১টা ১৪ মিনিটে একরামের মেয়ে আবারও ফোন করে জানতে চায় তিনি কোথায় আছেন।
অপর প্রান্ত থেকে উত্তর আসে, “আমি টিএনও (ইউএনও) অফিসে যাচ্ছি তো, আমি চলে আসব আম্মা।”
ফিরতে কতক্ষণ সময় লাগবে- মেয়ের এ জিজ্ঞাসায় অপর প্রান্ত থেকে উত্তর আসে, “বেশিক্ষণ লাগবে না, আমি চলে আসব ইনশাল্লাহ, ঠিকাছে? ঘুমাও।”
রাত ১১টা ৩২ মিনিটে আবারও মেয়ে ফোন করলে তার বাবা বলেন, হ্নীলায় যাচ্ছেন।
কেন সেখানে যেতে হচ্ছে জানতে চাইলে উত্তর আসে, তিনি ‘জরুরি কাজে’ যাচ্ছেন।
মেয়ে তার কাছে আবারও জানতে চায়- কেন?
ধরা গলায় জবাব আসে, “যাচ্ছি আম্মু ঠিকাছে … যেতে হচ্ছে তা…।”
মেয়ে তখন জানতে চায়, তার বাবা কেন কাঁদছে।
এই অবস্থায় ফোন নেন আয়েশা। তিনি হ্যালো হ্যালো করতে করতেই ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
রাত ১১টা ৫৪ মিনিটে আবার ফোন করেন একরামের স্ত্রী। ফোন রিসিভ হওয়ার আগে তিনি প্রার্থনা করতে থাকেন যেন একবার স্বামীর সঙ্গে কথা হয়।
ফোন রিসিভ হলে আয়েশা বলেন, “হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো কে? হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো আমি কমিশনারের সাথে কথা বলতে চাচ্ছি। হ্যালো কে ওইটা, ফোন রিসিভ করছে ওইটা কে? আমি উনার মিসেস বলতেছি, হ্যালো, হ্যালো…।”
এমন সময় ফোনের অপর পাশে কাউকে বলতে শোনা যায় “… তুমি যেটা বলছ,… জড়িত না? কেউ একজন বলেন, নাহ। এরপর অগ্নেয়াস্ত্র কক করার শব্দ এবং দুটি গুলির শব্দ শোনা যায়। সেই সঙ্গে মরণাপন্ন কারও চিৎকার।
ওই আওয়াজে চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন একরামের স্ত্রী ও মেয়েরা।
আয়েশা বলেন, “ও আল্লা আমার জামাই কিছু করে নাই। আমার জামাই কিছু করে নাই। আমরা বিনা দোষী। আমার জামাই, আমার হাজব্যান্ড কিছু করে নাই, আমার হাজব্যান্ড কিছু করে নাই।”
এ সময় ফোনের অপর প্রান্ত থেকে কয়েকজনের কথা শোনা গেলেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। বার বার বাঁশির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। পরে গালিগালাজের আওয়াজও শোনা যায়।
এক পর্যায়ে একরামের স্ত্রী চিৎকার করে জানতে চান- “আপনারা কোথায়, আপনারা কোথায়…।”
অপরপ্রান্তে বাশির শব্দ বাড়তে থাকে। গালিও শোনা যায়।
কাঁদতে কাঁদতে আয়েশা বলতে থাকেন, “আমার জামাই কিছু করে নাই। কমিশনার কিছু করে নাই। আপনারা শুয়ারের বাচ্চা কেন বলতেছেন? উনি কিছু করে নাই। আমার হাজব্যান্ড কিছু করে নাই, কমিশনার কিছু করে নাই, উনাকে কেন মারতাছেন? আপনারা উনাকে কেন মারতাছেন?”
অন্য প্রান্ত থেকে কয়েকজনের কণ্ঠ শোনা গেলেও তাদের কথা বোঝা যাচ্ছিল না। কিছু একটা খুঁজে বের করতে কেউ নির্দেশ দেন। এরপর একজন বলেন, বাড়ি কই বাড়ি? এরপর গাড়ির সাইরেনের শব্দ শোনা যায়।
পরে আরও তিনটি গুলির শব্দ শোনা যায়, সঙ্গে অকথ্য গালি। ফোনের এ প্রান্ত থেকে আয়েশা বলতে থাকেন, তার স্বামী কিছু করেনি, কেন তাকে মারা হচ্ছে।
এক পর্যায়ে ‘খোসাগুলো’ খোঁজার কথা বলা হয় ফোনের অন্য প্রান্তে। পরে থেমে থেমে বেশ কয়েকটি গুলির শব্দ শোনা যায়। একজন বলেন, “আর লাগবে না, খোসাগুলো দেখ।”
১০ রাউন্ড গুলির কথা বলেন একজন। খোসা খোঁজাখুঁজি করেন। আটটি খোসা খুঁজে পাওয়ার কথা জানান একজন। সাইরেন বাজতে থাকে। আরও খোসা খুঁজে পাওয়ার কথা জানানো হয়।