নিউজ ডেস্ক:
কীভাবে কর ফাঁকি দিয়েছেন তারা, কীভাবে বেআইনি বিনিয়োগ করেছেন তারা বিদেশে, ফাঁস করল প্যানডোরা পেপারস। সংবাদমাধ্যমের বৃহত্তম অপারেশন।
ইনটারন্যাশনাল কনসর্টিয়াম অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট বা সংক্ষেপে আইসিইজে একটি মঞ্চ। বিশ্বের বহু বিশিষ্ট সাংবাদিক এই মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত। যুক্ত বিশ্বের ১৫০টি সংবাদসংস্থাও। তাদেরই উদ্যোগে বিশ্বের বৃহত্তম স্টিং অপারেশন বা অনুসন্ধানী অপারেশন সংঘটিত হয়েছে। যার নাম প্যানডোরা পেপারস। আর সেখানেই উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। সাবেক যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার থেকে জর্ডনের রাজা, কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট এবং একাধিক তারকার আর্থিক দুর্নীতির রোমহর্ষক তথ্য ফাঁস হয়েছে। স্পষ্ট হয়েছে, কীভাবে লাখ লাখ কর ফাঁকি দিয়ে তারা আর্থিক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন।
কেবলমাত্র ব্যক্তিগত দুর্নীতি নয়, প্যানডোরা পেপারসে বোঝা গেছে কীভাবে আর্থিক দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে। একাধিক দেশ, একাধিক নেতা, প্রশাসন, ব্যাঙ্ক কর্মকর্তা– সকলে এর সঙ্গে জড়িত। ইতিমধ্যেই সামনে এসেছে এমন বহু নাম। যারা এই চক্রের বিশিষ্ট অংশীদার। এরমধ্যে আছেন পাকিস্তান, নেদারল্যান্ডস, ব্রাজিলের অর্থমন্ত্রী। ব্যক্তিগত স্বার্থে যারা একাধিক বিদেশি সংস্থার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় যোগাযোগ তৈরি করেছেন। মাল্টা এবং ফ্রান্সের সাবেক অর্থমন্ত্রীও একই কাজ করেছিলেন। নিজেদের ব্যক্তিগত আর্থিক উন্নয়নের জন্য তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিলেন। সাবেক ইন্টারনাল মনিটারি ফান্ডের প্রধানও এর সঙ্গে জড়িত।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স বা সিপিআই সূচকের মাধ্যমে৷ দুর্নীতি নিয়ে বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী, গবেষক, বিশ্লেষকদের ধারণার উপর ভিত্তি করে শুন্য (উচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত) থেকে ১০০ (কম দুর্নীতিগ্রস্ত) পর্যন্ত স্কোরে সূচকটি পরিমাপ করা হয়৷
প্যানডোরা পেপারসে স্পষ্ট, সরকারের যেখানে বিদেশি সংস্থাগুলি যাতে আর্থিক দুর্নীতিতে মদত দিতে না পারে, সেটা দেখার কথা ছিল, সেখানে তারা ঠিক উল্টো কাজটাই করেছে। ব্যক্তিগত এ কাজ করতে গিয়ে তারা আন্তর্জাতিক কালোচক্র, দুর্নীতিকে আরো প্রশ্রয় দিয়েছে।
যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের বিরুদ্ধে এর আগেও আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তিনি এবং তার স্ত্রী কর ফাঁকি দেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু প্যানডোরা পেপারে তাদের বহু গোপন নথি ফাঁস হয়েছে। দেখা গেছে, কর বাঁচাতে বাহারিনের এক মন্ত্রীর পারিবারিক ব্যবসা কিনে নিয়েছিলেন টনি এবং তার স্ত্রী। বদলে পেয়েছিলেন আট দশমিক আট মিলিয়ন ডলারের একটি বিলাসবহুল বাড়ি। এই গোটা বিষয়টিই হয়েছিল পিছনের দরজা দিয়ে। যার ফলে প্রায় চার লাখ ডলারের কর বাঁচিয়েছিলেন ব্লেয়ার এবং তার স্ত্রী।
টনির স্ত্রী চেরি ব্লেয়ার জানিয়েছেন, তার স্বামী এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নন। যে সংস্থার কথা হচ্ছে সেটি বিক্রি হয়ে গেছে। টনি এবং বাহারিনের মন্ত্রী দুইজনেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তবে সাংবাদিকদের বক্তব্য, তাদের হাতে তথ্যপ্রমাণ আছে।
চেক প্রধানমন্ত্রী আন্ড্রেজ বাবিসের নামও জড়িয়েছে এই দুর্নীতি মামলায়। ২০১৭ সালে আন্ড্রেজ দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাক দিয়েই ক্ষমতায় এসেছিলেন। সেই ব্যক্তিই ২০০৯ সালে ফ্রান্সে এক পাহাড়ে বিশাল বাংলো কেনার জন্য আর্থিক দুর্নীতি করেছিলেন। একটি তেল কোম্পানিতে বিপুল টাকা ঢুকিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু করের কাগজে ওই তেল কোম্পানি এবং ওই বাংলোর বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করেননি তিনি।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধেও একই ধরনের আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। অভিযোগ উঠেছে কেনিয়ার প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে। কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট কেনিয়াট্টা সৎ ভাবমূর্তির মানুষ। তিনিও একসময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাক দিয়েছিলেন। অথচ দেখা যাচ্ছে, পানামায় একটি গোপন ফাউন্ডেশন তৈরি করে অর্থ নয়-ছয় করছেন তিনি। আর্থিক কেলেঙ্কারিতে যুক্ত আছেন তার মা-ও।
প্যানডোরা পেপারস প্রায় ২৯ হাজার অফ শোর সংস্থার এমন দুর্নীতি ফাঁস করেছে। যেখানে অবৈধভাবে যুক্ত হয়েছেন বহু রাষ্ট্রনেতা এবং তারকা। ওই সমস্ত সংস্থাকে ব্যবহার করে তারা কর ফাংকি দিয়েছে। বাংলো বানিয়েছে। বিলাসবহুল ইয়ক কিনেছে। এমনকী, দামি ছবিও কিনেছে।
জর্ডনের রাজা এভাবেই মালিবুতে তিনটি বাংলো কিনেছেন বলে অভিযোগ। আরব স্প্রিং আন্দোলনের সময় তিনি এ কাজ করেছিলেন বলে অভিযোগ। যদিও জর্ডনের রাজার আইনজীবী অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
মরোক্কোর রাজুপুত্র, সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী, দুবাইয়ের আমির– সকলের বিরুদ্ধেই আর্থিক নয়-ছয়ের একাধিক অভিযোগ সামনে এসেছে। কাতারের আমির এখনো অফশোর সংস্থাকে ব্যবহার করে কর ফাঁকি দিচ্ছেন এবং ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে প্যানডোরা পেপারসের অভিযোগ।
পপস্টার শাকিরা, ক্রিকেটার শচিন টেন্ডুলকারের নামও উঠে এসেছে এই দুর্নীতি মামলায়। শাকিরার আইনজীবী অবশ্য জানিয়ছে, পপস্টারের কোনো গোপন বিদেশি বিনিয়োগ নেই। সবই করের কাগজে উল্লেখ করা আছে। ফলে তার মাধ্যমে কর বাঁচানোর কোনো সুযোগ নেই। টেন্ডুলকারের আইনজীবীও একই কথা জানিয়েছেন।
গোটা পৃথিবীর ১৩০ জন বিলিয়োনেয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগ সামনে এসেছে। গত কয়েক দশকে প্যানডোরা পেপারস সবচেয়ে বড় আর্থিক দুর্নীতির স্টিং অপারেশন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই মামলা বিশ্বের রাজনীতি এবং কূটনীতিতে প্রভাব ফেলবে বলেও মনে করছেন অনেকে।