মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের অবস্থা সরেজমিন দেখতে বাংলাদেশ সফরে আসছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম।
এ লক্ষ্যে আগামী ৩০ জুন তিন দিনের জন্য ঢাকায় আসছেন, থাকবেন দুই জুলাই পর্যন্ত। এ সময় তারা রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প পরিদর্শন করবেন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করবেন সংস্থা দুটির প্রধান। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এবং বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, জাতিসংঘের মহাসচিব এর আগে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের প্রধান থাকাকালে ২০০৮ সালে একবার রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে এসেছিলেন। কিন্তু জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে এই প্রথম সফরে আসছেন তিনি।
অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমের এটি দ্বিতীয় সফর। এর আগে বিশ্ব দারিদ্র্য নিরসন দিবস পালন উপলক্ষে অতিথি হিসেবে গত বছর ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জনের স্বীকৃতি হিসেবে ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে।
ঢাকায় আসার পর গুতেরেস ও জিম ইয়ং কিম কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করবেন। তারা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গেও বৈঠক করবেন বলে জানা গেছে।
ইআরডির সচিব কাজী শফিকুল আযম সোমবার যুগান্তরকে জানান, এই দুই আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানের বাংলাদেশ সফর বর্তমান সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সফরটি সমন্বয় করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সুতরাং তাদের সফরসূচির বিষয়টি সেখান থেকেই জানা যাবে।
সূত্র জানায়,গত বছরের আগস্ট মাস থেকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ব্যাপক হারে বাংলাদেশে আসতে শুরু করে। সাম্প্রতি শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম স্বাক্ষরিত এক সার-সংক্ষেপে বলা হয়েছে, এ পর্যন্ত বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্র্রেশন সম্পূর্ণ হয়েছে ১০ লাখ ৯৭ হাজার ৭৭১ জন রোহিঙ্গার। এদের মধ্যে পুরুষ হচ্ছে ৪৮ শতাংশ এবং মহিলা ৫২ শতাংশ।
এছাড়া শিশু রয়েছে ৫৫ শতাংশ, এতিমের সংখ্যা ৩৬ হাজার ৩৭৩ জন, এর মধ্যে ৭ হাজার ৭৭১ জন তাদের বাবা-মাকে হারিয়ে ফেলেছে। ১৮ হাজার মহিলা রয়েছেন গর্ভবতী, এরই মধ্যে শিশুর জন্ম হয়েছে ২৯ হাজার ২৮৯টি। এতে আরও বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের কারণে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরের মধ্যে স্থানীয় হাজারও কৃষক তাদের জমির ধান থেকে কোনো ফসল পাননি। অনেকেই তাদের জমি হারিয়েছেন।
রাস্তাঘাট, ব্রিজ, বাজার, হাসপাতাল ইত্যাদির সক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া স্কুল, উপজেলা কমপ্লেক্স এবং কমিউনিটি সেন্টারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নানা সংস্থা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটছে।
স্বল্প আয়ের স্থানীয় মানুষ বিশেষ করে যারা দৈনিক হাজিরায় কাজ করেন তারা তাদের কাজ হারিয়েছেন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে রোহিঙ্গাদের স্বল্প দামেই কাজে লাগানো যাচ্ছে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। ইতিমধ্যেই প্রায় ৫ হাজার ৮০০ হেক্টর সংরক্ষিত বন কেটে তৈরি হয়েছে রোহিঙ্গাদের ঘর। এছাড়া রোহিঙ্গাদের জ্বালানির চাহিদা পূরণে প্রতিনিয়ত বনের গাছ কাটা হচ্ছে।
সাড়ে ৪ হাজার একর জায়গার মধ্যে ৩৫ হাজার পায়খানা এবং ৭ হাজার টিউবওয়েল বসানো হয়েছে। ফলে উখিয়ার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার হুমকিতে রয়েছে। এ কারণে পরিবেশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। হাতির বিচরণ ক্ষেত্র ও করিডরে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে তাদের খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে।
সূত্র জানায়, মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলেও বাংলাদেশের পক্ষে তাদের ভরণপোষণ ও যতদিন এখানে অবস্থান করবেন ততদিন সুস্থ জীবন নিশ্চিত করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় তাদের পাশে এসে দাঁড়ানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বনেতাদের আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশ ও দাতা সংস্থা এগিয়ে এসেছে।
বিশ্বব্যাংকও রোহিঙ্গাদের সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। গত এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বসন্তকালীন বৈঠকে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের সাহায্যের প্রতিশ্র“তি দেয় সংস্থাটি। এ পরিপ্রেক্ষিতে একটি সহায়তা মিশন সম্প্রতি কাজ শেষ করেছে। একই সঙ্গে অন্যান্য দাতা সংস্থা ও দেশ যৌথভাবে সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে এবং ইতিমধ্যেই কিছু সাহায্যও পাওয়া যাচ্ছে।
এছাড়া রোহিঙ্গাদের ওপর ইতিহাসের বর্বরোচিত নির্যাতনকে জাতিগত নিধন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে জাতিসংঘ। সংস্থাটির মহাসচিব রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের জন্য মিয়ানমার সামরিক জান্তার কঠোর সমালোচনা করেন এবং রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তার জন্য বিশ্ববাসীকে পাশে দাঁড়ানোরও আহ্বান জানান।