নিউজ ডেস্ক:
বিজ্ঞাপন বিহীন অনুষ্ঠান সম্প্রচারের সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার পরও কোনো বিদেশি চ্যানেল সেটা মানেনি বলে ১ অক্টোবর থেকে সব বিদেশি চ্যানেল বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতি একাত্মতা জানিয়েছেন অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্স (অ্যাটকো)-এর সহ-সভাপতি মোজাম্মেল বাবু। শনিবার সন্ধ্যায় সংগঠনের সভাপতি অঞ্জন চৌধুরীর পক্ষে এই ঘোষণা দেন।
তবে যেসব বিদেশি চ্যানেলগুলো বন্ধ আছে, সেই চ্যানেলগুলো যেন আমরা পুনরায় সচল করতে উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানিয়েছে কেবল অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (কোয়াব) নেতারা। বিজ্ঞাপনবিহীন বা ক্লিন ফিড বিদেশি চ্যানেল প্রচারের বিপক্ষে নন জানিয়ে তারা বলেছেন, শুধু বাংলাদেশি ৩৪টি চ্যানেল দিয়ে কেবল অপারেটর সেবা চালু রাখলে গ্রাহক ধরে রাখা সম্ভব হবে না।
ক্লিন ফিড বিদেশি চ্যানেল বন্ধ রাখার প্রেক্ষিতে শনিবার বিকালে রাজধানীর বনানীর একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে কোয়াব নেতারা এসব কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে কোয়াব সভাপতি আনোয়ার পারভেজ ২০০৬ সালের কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইনটি সংশোধনের দাবি জানান।
কোয়াবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এসএম আনোয়ার পারভেজ বলেন, সরকার যে অর্ডার দিয়েছে- আমরা সেটি অক্ষরে অক্ষরে পালন করছি। তথ্য মন্ত্রণালয় আমাদের অভিভাবক। কেবল অপারেটরদের পক্ষ থেকে তথ্যমন্ত্রীর কাছে বিনীত আবেদন করছি, ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়া কমপ্লিট না হওয়া পর্যন্ত অন্তত যেসব বিদেশি চ্যানেলগুলো বন্ধ আছে, সেই চ্যানেলগুলো যেন আমরা পুনরায় সচল করতে পারি, সে ব্যাপারে যেন তিনি একটা উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
কোয়াব নেতারা আশঙ্কা করছেন, গ্রাহকেরা তাদের নিজেদের স্বার্থে ইউটিউব, ফেসবুকসহ বিভিন্ন ওটিটি প্ল্যাটফর্মে চলে যাবেন। এতে দ্রুত গ্রাহক কমে যাবে। কেবল অপারেটর ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। একপর্যায়ে তাদের পক্ষে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা দুরূহ হবে।
কোয়াব সভাপতি বলেন, ‘২৫ বছরে তিলে তিলে গড়ে তোলা আমাদের এই কেবল ইন্ডাস্ট্রি। এখানে আমাদের ৪ লাখ মানুষের রুটিরুজির বিষয় জড়িত। ইউটিউবের রমরমা অবস্থা। যেসব বিদেশি চ্যানেল বাংলাদেশে বন্ধ হয়েছে, সেসব চ্যানেল তাদের প্রতিটি সিরিয়াল সঙ্গে সঙ্গে ইউটিউবে আপলোড করে দিচ্ছে। সেখানে কিন্তু বাংলাদেশি পণ্যের বিজ্ঞাপন ইউটিউবে যাচ্ছে। এই টাকাটা কিন্তু চলে যাচ্ছে ইউটিউব কোম্পানির কাছে। ’
দেশের বাইরে থেকে অনেকগুলো অ্যাপস চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘হইচই, নেটফ্লিক্স, আমাজন, হট স্টার, জি-ফাইভ। এরা কিন্তু বাংলাদেশ থেকে গ্রাহক নিচ্ছে। কোনো বৈধ উপায়ে তারা গ্রাহক নিচ্ছে না। এরা কিন্তু গ্রাহকের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে অনেক টাকা নিয়ে যাচ্ছে।’
কোয়াব সভাপতি প্রশ্ন রেখে বলেন, বিদেশি চ্যানেল বন্ধ থাকলেও গ্রাহক বসে থাকবেন না। মানুষ কিন্তু বসে থাকবে না। সুইচ করবে, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যাবে। এই সুইচ করার ফলে যদি কেবল টিভি নেটওয়ার্কের ব্যবসা রাস্তায় বসে যায়, আমরা যদি এই সেক্টরে জড়িত মানুষকে বেকারত্বের দিকে ঠেলে দিই, তাহলে এর দায়ভার কে নেবেন?
সংবাদ সম্মেলনে কোয়াবের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এবিএম সাইফুল হোসেনও একই আশঙ্কা প্রকাশ করে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, বিদেশি চ্যানেল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গ্রাহক হারিয়ে ব্যবসা বন্ধের উপক্রম হবে। শুধু ৩৪টি বাংলা চ্যানেল দিয়ে গ্রাহক ধরে রাখা সম্ভব নয়। দর্শকের বিনোদন চাহিদা পূরণ করার জন্য কেবল টিভি একমাত্র মাধ্যম না। এখন নেটফ্লিক্স, হইচই- এমন হাজারো প্ল্যাটফর্ম আছে।
অপরদিকে শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় অ্যাটকো আয়োজিত ভার্চুয়াল প্রেস কনফারেন্সে ৭১ টিভির প্রধান নির্বাহী মোজাম্মেল বাবু বলেন, সরকারের তরফ থেকে বেঁধে দেওয়া সময়সীমা পার হওয়ার কারণে ১ অক্টোবর থেকে সকল বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অন্য দেশে চ্যানেল সম্প্রচারের ক্ষেত্রে, সারা বিশ্বে বিজ্ঞাপন শূন্য অনুষ্ঠান প্রচারের নিয়ম এবং আইন রয়েছে। পৃথিবীর সব দেশে এই আইন মেনে চলে। আমাদের দেশেও সর্বশেষ অ্যাটকো এবং কোয়াবের সদস্যদের নিয়ে সরকারের সঙ্গে যে আলোচনা হয়েছে, তাতে এই প্রসঙ্গে আ্যাটকো এবং কোয়াব একমত হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেটা মানা হয়নি বলেই বাধ্য হয়ে সরকারকে আইনি পদক্ষেপ নিতে হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেওয়া সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মোজাম্মেল বাবু বলেন, ১২০০ কোটি টাকার বিজ্ঞাপন বিদেশি চ্যানেলে প্রচারিত হয়। যার মধ্যে ৩০০ কোটি টাকা সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্স রয়েছে। বাকী টাকা বিদেশি চ্যানেলে খরচ না হলে আমাদের দেশীয় টেলিভিশনগুলো তার অংশ পেত। আমরা টেলিভিশনগুলো পুরোপুরি বিজ্ঞাপনের উপর নির্ভরশীল, অথচ এতগুলো টাকা নিয়ে যায় বিদেশি চ্যানেলগুলো।
তিনি বলেন, সরকারের আইনি এই উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানাই। কোনো চ্যানেল বিজ্ঞাপন শূন্য তাদের অনুষ্ঠান প্রচার করলে কোনো সমস্যা নেই। আমাদের অনেক কোম্পানির বিজ্ঞাপন কিন্তু পাশের দেশে প্রচারিত হয় না। যদিও এর জন্য তারা টাকা নিচ্ছেন। সেখানে প্রচার না করার মতো প্রযুক্তি তাদের রয়েছে। তারা সেটা ব্যবহার করছেন। তাহলে আমাদের দেশে তাদের চ্যানেলের বিজ্ঞাপন কেনো প্রচার করা হবে?
সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিদেশি যে কোনো চ্যানেলকে আইন মেনে অবশ্যই ক্লিন ফিড বা বিজ্ঞাপন ছাড়াই প্রোগ্রাম সম্প্রচার করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এখানে কেউ ব্ল্যাকমেইল করতে চাইলেই হবে না। সবাই সরকারের আইনি এই সিদ্ধান্ত মেনেই নিয়েছে। ক্লিনফিড প্রোগ্রাম প্রচারের জন্য তাদের একটা অংশ এখন উল্টো যুক্তি দেখাচ্ছে।
এদিকে ক্যাবল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব) বলেছে, ৪ অক্টোবরের পর তারা কঠোর আন্দোলনে যাবে। এব্যাপারে অ্যাটকোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করেন সময় টেলিভিশনের এহসান জুয়েল। জবাবে মোজাম্মেল বাবু বলেন, সরকারের পূর্ব ঘোষিত এবং আইনগত কোন সিদ্ধান্তের বিপক্ষে কারো যাওয়ার সুযোগ নেই। এটা আসলে আন্দোলনের বিষয়ও না। এটা মানা ছাড়া বিকল্প কোনো রাস্তা নেই। এটা সারা বিশ্বেই প্রচলিত নিয়ম এবং আইন। তাছাড়া কোয়াব তো সরকারের কাছে সময় প্রার্থনা করেছে। সেখানে হঠাৎ করে কঠোর আন্দোলনের প্রশ্ন আসছে কী ভাবে? এটাও এক ধরনের ব্ল্যাকমেইল।
দীপ্ত টিভির রুবায়েতের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিদেশি চ্যানেলগুলো ক্লিন ফিড না দিলে আমাদের বা সরকারের কী করার আছে? আইন তার নিজের গতিতে চলবে। এই সিদ্ধান্ত মেনে চলা ছাড়া চ্যানেলগুলোর কোনো উপায় নেই। এটা নতুন কোনো বিষয় না। চ্যানেলের মালিকরা সেটা জানেন। তারা নিশ্চয়ই ক্লিন ফিড প্রোগ্রাম চালাবেন।
একুশে টিভির আদিত্যর প্রশ্ন ছিল- ক্যাবেল অপারেটররা বলছে, দেশীয় ৩৪/৩৫টা চ্যানেল দর্শক তেমন দেখে না। তাই এসব চ্যানেল চালিয়ে কোয়াব চলতে পারবে না। এসব চ্যানেলের মান বাড়ানোর ক্ষেত্রে অ্যাটকো কোন ভূমিকা নিতে পারে কীনা?
জবাবে মোজাম্মেল বাবু বলেন, চ্যানেল মালিকদেরই তাদের চ্যানেলের প্রোগ্রামের মান বাড়ানোর জন্য কাজ করতে হবে। এখানে জোর করে কাউকে দিয়ে মান বাড়ানো যাবে না। কারা সংবাদ প্রচার করবেন, কারা এন্টারটেইমেন্ট কিংবা কারা খেলা দেখাবেন, সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। তবে হ্যাঁ, মান আরও ভালো করতে হবে সবার, এব্যাপারে দ্বিমত নেই।
মোজাম্মেল বাবু বলেন, আমাদের সবকটি টেলিভিশন বিজ্ঞাপন নির্ভর। আমাদের বাজার ছোট। তার উপর যদি ১২০০ কোটি টাকা বিদেশি চ্যানেলের কাছে বিজ্ঞাপন বাবদ চলে যায়, তাহলে অন্যরা বাঁচবে কী করে? বিজ্ঞাপন বাইরের চ্যানেলে দেওয়া বন্ধের পাশাপাশি আমাদের চ্যানেলগুলোর মান বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকার বাধ্য করতে পারে। অনুষ্ঠানের মাঝে বিজ্ঞাপন প্রচারের সময়সীমাও নির্ধারণ করে দিতে পারে। এতে দর্শক হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে।
মাইটিভির আবীরের প্রশ্ন ছিল, কোয়াব ৪ অক্টোবরের পরে যে কঠোর আন্দোলনের কথা বলেছে, তাদের সঙ্গে অ্যাটকো কি এ ব্যাপারে কোনো আলোচনায় বসবে?
জবাবে অ্যাটকো সহ-সভাপতি বলেন, এটা আসলে আমাদের বিষয় না। আইনি এবং সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়। দেশের যে কোনো নাগরিকের উচিত আইনি এই উদ্যোগকে সহায়তা করা। এরকম ব্যাপারে কেউ চাইলেই ব্ল্যাকমেইল করতে পারেন না। এ আইনটি নতুন নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই এর প্রয়োগ রয়েছে। আমরা বরং এই আইনকে সাধুবাদ জানাই।
অ্যাটকো আয়োজিত ভার্চুয়াল এই প্রেস কনফারেন্সে আরও বেশ কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী উপস্থিত ছিলেন। যাদের মধ্যে ছিলেন- রাকিব হাসান, মো. আরাফাত, সজীব, শিহাব, পারভেজ রেজা প্রমুখ।