Highlights

রাজধানীতে পাঁচ হাজার বিদেশির অপরাধ সিন্ডিকেট

Published

on

অপরাধ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত বিদেশিরা। ফাইল ফটো
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে অবৈধভাবে বসবাস করছে প্রায় ১৫ হাজার বিদেশি নাগরিক। তাদের মধ্যে ৫ হাজার নাগরিকের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। টুরিস্ট, খেলোয়াড়, বিজনেস কিংবা স্টুডেন্ট ভিসায় বাংলাদেশে এসে ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ফিরে না গিয়ে অবৈধভাবে বসবাস করছেন অনেকেই। তাদের বেশিরভাগই বিভিন্ন সময়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরাও পড়েছেন। এরপর তারা জামিন নিয়ে আবারও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। বেশ কয়েকজন নাগরিক আবার জামিন নিয়ে গোপনে নিজ দেশে চলেও গেছেন।

গত তিন বছরে দুই শতাধিক বিদেশি অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বাংলাদেশে ফেসবুকে উপহার পাঠানোর নামে প্রতারণা, হেরোইন, কোকেন ও অপ্রচলিত মাদকের কারবার, ব্যাংকের এটিএম বুথে জালিয়াতি, ক্রেডিট কার্ড জালিযাতি, জাল ডলারের কারবার, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, সোনা চোরাচালান, অনলাইনে ক্যাসিনো এবং মানবপাচারে জড়িত থাকার অপরাধে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এসব বিদেশিরা এদেশে এসেই পাসপোর্ট নষ্ট করে ফেলেন। রাজধানীর উত্তরা, গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমন্ডি, নিকুঞ্জ, বনশ্রীসহ অভিজাত এলাকায় তারা বাড়িভাড়া অথবা হোটেল ভাড়া নিয়ে থাকেন। ঢাকায় ওইসব দেশের দূতাবাস নেই বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের সহায়তা করতে পারে না। এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে ওই সব দেশের অপরাধীরা বছরের পর বছর ধরে ঢাকায় অবস্থান করে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নাইজেরিয়া, ঘানা, সেনেগাল. ক্যামেরুন, লাইবেরিয়া, কেনিয়াসহ আফ্রিকার ১০টি দেশের ৫ হাজার নাগরিক অবৈধভাবে বসবাস করে বছরের পর বছর ধরে ভয়ঙ্কর প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। পাশাপাশি কয়েক হাজার অবৈধ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, চীন ও তাইওয়ান নাগরিকের বিরুদ্ধেও রয়েছে একই ধরনের অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ। পুলিশ ও র‌্যাব তাদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানোর পর নানাবিধ সমস্যার কারণে সরকার তাদেরকে নিজ দেশে ফেরাতেও পারছে না।

ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, গ্রেপ্তার আফ্রিকানদের সম্পর্কে তদন্ত করতে গিয়েও নানা ঝামেলা পোহাতে হয়। কারণ গ্রেপ্তারকৃত অধিকাংশ আফ্রিকান সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তাদের পাসপোর্ট বা বাংলাদেশে প্রবেশের বৈধ কোনো কাগজপত্রের হদিস মেলে না। ফলে তাদের নাম-ঠিকানা যাচাই করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ কারণে গ্রেপ্তারের পর তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিটও দেয়া যায় না। দুই বছর আগে ঢাকায় ক্রডিট কার্ড জালিয়াতির অভিযোগে পান্থপথের একটি হোটেল থেকে ডিবি ৬ ইউক্রেনীয় নাগরিককে গ্রেপ্তার করে। পরে তারা জামিন নিয়ে গোপনে নিজ দেশে চলে যান।

ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের লালবাগ বিভাগের মশিউর রহমান বলেন, এসব বিদেশিরা ভিসার মেয়াদ শেষ হলে পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলেন। রাজধানীতে বেশ কিছু লোভী বাড়ির মালিক অথবা হোটেল মালিক টাকার লোভে তাদের থাকতে দেন। এক্ষেত্রে ওইসব বিদেশির পাসপোর্ট বা পরিচয় সংক্রান্ত কোনো তথ্যই সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠানো হয় না। অপরাধী হিসাবে তাদের গ্রেপ্তার করার পর জামিনে বেরিয়ে গা-ঢাকা দেন। তাদের শনাক্ত করার পাশাপাশি ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে কী করণীয়, তা নির্ধারণে দুই বছর আগে সংশ্লিষ্ট বিভাগে চিঠি দেয়া হয়েছে।

মাদক কারবার ও অনলাইনে প্রতারণায় জড়িত থাকার অভিযোগে গত বছরের নভেম্বর মাসের শুরুতে উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ক্যামেরুনের চার অবৈধ নাগরিকসহ ছয়জনকে। আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রির সঙ্গে জড়িত থাকার কথাও স্বীকার করেন বিদেশি এই অপরাধীরা। গত ২৭ আগস্ট বারিধারা ও কাওলা থেকে সিসম, মরো মহাম্মদ, মরিসন, অ্যান্থনি নামে নাইজেরিয়া ও ঘানার চার নাগরিককে গ্রেপ্তার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গত ২১ জুলাই পল্লবী থেকে বাংলাদেশি নারীসহ ১২ নাইজেরিয়ানকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি।

ডিবির লালবাগ বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান বলেন, এসব বিদেশি চক্র ঢাকায় বসে ফেসবুক ব্যবহার করে এজেন্টের মাধ্যমে প্রতারণার ফাঁদ পাতেন। প্রথমে তারা ফেসবুকে আইডি খুলে বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। ই-মেইল, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারেও তারা বন্ধুত্ব গড়েন। একপর্যায়ে মোটা অঙ্কের টাকার লোভ দেখান। ইন্টারনেট ও মোবাইলে লোভনীয় লটারি পাওয়ার মেসেজ পাঠিয়ে মূল্যবান গিফট পাঠানোর কথা বলে পার্সেল ফি আদায় করে প্রতারণা চালান।

পুলিশের বিশেষ শাখার (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) সূত্র জানায়, এ দেশে অবৈধ বা বৈধভাবে বসবাসকারী বিদেশি প্রতারক চক্রের প্রতারণার অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর বিদেশি নাগরিকের ডাটাবেজ তৈরির কাজ চলছে। গত চার মাসে প্রায় এক হাজার বিদেশির ওপর অনুসন্ধান ও নজরদারি করা হয়। দেশে প্রায় দুই লাখ বিদেশি অবস্থান করছে। তাদের মধ্যে ১৭ হাজার আফ্রিকানসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিক রয়েছে, যারা দেশের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের মধ্যে বাংলাদেশে অবৈধভাবে বসবাসকারী ১৫ হাজার বিদেশিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ১৫ হাজার অবৈধ বিদেশির মধ্যে ৫ হাজার বিদেশি নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত।

এমন পরিস্থিতিতে অন্তত ১০টি দেশের কয়েক হাজার অপরাধীর তালিকা তৈরি করে অভিযান শুরু করা হয়েছে। একই সঙ্গে অবৈধ বিদেশি নাগরিকদের অপরাধে সহায়তাকারী দেশীয় অপরাধী চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধেও অভিযানে নেমেছে পুলিশ, র‌্যাব, সিআইডি, এসবি। এছাড়া অবৈধ বিদেশিদের কাছে বাড়ি ভাড়া দিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছে পুলিশ। বিদেশিদের কাছে বাসা ভাড়া দেয়ার সময় বাড়ির মালিককে অবশ্যই তার পরিচয় নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রাখতে হবে। একই সঙ্গে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট থানাকেও অবহিত করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version