ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর রোগীতে উপচে পড়া হাসপাতালের বাইরে অস্থায়ীভাবে বানানো তাঁবুতে শিশু-বৃদ্ধসহ শত শত আহত মানুষের জীবন বাঁচাতে মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন হাইতির চিকিৎসকরা।
শনিবারের ৭ দশমিক ২ মাত্রার ওই ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা বেড়ে এক হাজার ৪১৯ জনে দাঁড়িয়েছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
উদ্ধারকর্মীরা যখন ধ্বংসস্তূপের মধ্যে জীবিতদের সন্ধানে তৎপরতা চালাচ্ছে, তখনই একটি ঝড় হাইতির দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলে তুমুল বৃষ্টি ঝরিয়েছে।
ভারি বর্ষণে ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত এলাকার কাছে দেখা দেওয়া বন্যা মানবিক সংকটকে তীব্রতর করে তুলেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
বন্যার বিষয়টি রয়টার্সকে নিশ্চিত করেছেন জেকমেল এলাকার রাজনীতিক ডিউস ডেরোনেথ; শহরের মধ্য দিয়ে বন্যার পানির স্রোত বয়ে যাচ্ছে- টুইটারে এমন ভিডিও-ও পোস্ট করেছেন তিনি।
ভূমিকম্পে অর্থনৈতিকভাবে নাজুক দেশটির হাজার হাজার ভবন ধসে পড়েছে।
ক্যারিবীয় এ দেশটি এখনও ১১ বছর আগের আরেকটি ভয়াবহ ভূমিকম্পের ধকল সামলে উঠতে পারেনি। ২০১০ সালের ওই ভূমিকম্প দেশটির দুই লাখের বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল।
চলতি বছর ৭ জুলাই হাইতির প্রেসিডেন্ট জোভেনেল ময়িস নিজের বাড়িতে খুন হন। এ ঘটনাও ক্যারিবিয়ান সাগরের দ্বীপ দেশটিকে টালমাটাল করে রেখেছে।
সর্বশেষ ভূমিকম্পে অসংখ্য চার্চ, হোটেল, বাড়ি ও স্কুলের মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা ধসে পড়েছে।
সোমবার স্থানীয় সময় বিকালে হাইতির কর্তৃপক্ষ ভূমিকম্পে এক হাজার ৪১৯ জনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। ছয় হাজার ৯০০ জনের মতো আহত এবং ৩৭ হাজার ৩১২টি ঘর ধ্বংস হয়েছে বলেও জানিয়েছে তারা।
মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সবচেয়ে বিপর্যস্ত লি কাইয়ে শহর ও এর আশপাশের এলাকার হাসপাতালগুলোতে সৃষ্টি হয়েছে রোগীর মারাত্মক চাপ; এ হাসপাতালগুলোর বেশ কয়েকটি ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
লি কাইয়ে শহরটি হাইতির রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের প্রায় দেড়শ কিলোমিটারের পশ্চিমে অবস্থিত।
ভূমিকম্পে সমুদ্রের তীরবর্তী এক লাখ বাসিন্দার শহর লি কাইয়ের প্রধান সড়কের সারিবদ্ধ ভবনগুলো ধসে পড়ে আছে।
সোমবারও শহরটির সরকারি হাসপাতালে উপচে পড়া রোগীর ভিড় দেখা গেছে। ভেতরে জায়গা না পেয়ে পার্কিং লটের তাঁবুতে থাকা রোগীদের সেবা দিতে ছুটছেন চিকিৎসক ও নার্সরা। বাইরে ঘাসের ওপর বিছানো ম্যাট্রেস ও বিছানাতেও অসংখ্য মানুষ শুয়ে আছেন।
হাসপাতালের ভেতরেও ভিড়ের কমতি নেই। শয্যা না পাওয়া অনেক রোগীর আশ্রয় হয়েছে মেঝেতে বিছানো স্ট্রেচারে।
ভূমিকম্পের পর অনিরাপদ বিবেচিত হওয়ায় হাসপাতালের নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা ইউনিট ভবন থেকে শিশুদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন এক প্রত্যক্ষদর্শী।
হাসপাতালে এন্টিবায়োটিক ও এনেস্থেটিকস শেষ হয়ে আসছে বলে জানিয়েছে শনিবার থেকে অস্থায়ী নবজাতক ওয়ার্ডে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে যাওয়া শিশু বিশেষজ্ঞ ড. লুসেট গেডন।
“ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়ে ছিল এমন অনেক শিশু আসছে যাদের আঘাতপ্রাপ্ত বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে ফেলা দরকার,” বলেছেন তিনি।
হাসপাতালের বাইরে মার্সেলিন চার্লস নামে এক নারী জানান, ভূমিকম্পে তার বাড়ি ধসে পড়ার সময় একটি ইট তার এক মাস বয়সী শিশুর উপর পড়েছিল; ধ্বংসাবশেষ তার ৭ বছর বয়সী মেয়ের মাথায় গভীর ক্ষতও সৃষ্টি করেছে।
“ও বাঁচবে কিনা জানিনা,” বলেছেন চার্লস।
কাছাকাছি থাকা মিশেল দেলভা জানান, ভূমিকম্পের সময় তার বোন ক্লডিন খসে পড়া ইটের হাত থেকে মেয়েকে বাঁচাতে ঢাল হয়ে ছিলেন; এতে তার পা ভেঙে যায়। এখন অস্ত্রোপচার করা প্রয়োজন হয়ে পড়লেও শনিবার থেকে তারা হাসপাতালের বাইরেই অপেক্ষারত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন।
হাইতির প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরি বলেছেন, এখন নষ্ট করার সময় নেই।
“এই সোমবার থেকে আমরা দ্রুতগতিতে অগ্রসর হব। সাহায্যের ব্যবস্থা ত্বরান্বিত হতে চলেছে। যত বেশি সংখ্যক ক্ষতিগ্রস্তের কাছে সাহায্য পৌঁছানো যায়, তার জন্য আমরা আমাদের চেষ্টা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেবো,” টুইটারে এমনটাই লিখেছেন তিনি।
সোমবার পোর্ট-অ-প্রিন্সের বিমানবন্দরে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে ত্রাণ ও অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে যেতে চাওয়া বিপুল সংখ্যক চিকিৎসক ও সাহায্যকর্মীকে দেখা গেছে।
ভূমিকম্পে কিছু এলাকার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি লি কাইয়েতে প্রবেশের গুরুত্বপূর্ণ পথগুলো বিভিন্ন অপরাধী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে থাকায় শহরটিতে সড়কপথে সহজে যাওয়াও যাচ্ছে না।
অপরাধী গোষ্ঠীগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকা দিয়ে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে যেতে ‘মানবিক করিডোর’ তৈরির আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ।
মোয়িস হত্যাকাণ্ডের পর যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে তার নিরসনে দেশটিতে নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে, কিন্তু ভয়াবহ এ দুর্যোগের কারণে শেষ পর্যন্ত তা করা যাবে কিনা, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।